আজ শ্রীমঙ্গল মুক্ত দিবস

‘গণহত্যার সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে উঠে’

‘গণহত্যার সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে উঠে, ভয় লাগে। সেদিন যেন ছিল লাশের মিছিল। চারদিকে লাশ—লাশের ওপরে লাশ। খালে লাশগুলো ২-৩ দিন পড়ে ছিল। যে কয়জন তখনো বাগানে ছিলেন, তাদেরকে ধরে এনে হত্যা করা হয়।’
গণহত্যা
শ্রীমঙ্গল-ভাড়াউড়া সড়কের পাশে বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

'গণহত্যার সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে উঠে, ভয় লাগে। সেদিন যেন ছিল লাশের মিছিল। চারদিকে লাশ—লাশের ওপরে লাশ। খালে লাশগুলো ২-৩ দিন পড়ে ছিল। যে কয়জন তখনো বাগানে ছিলেন, তাদেরকে ধরে এনে হত্যা করা হয়।'

১৯৭১ সালের ১ মে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাড়াউড়া চা বাগানে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পরের দৃশ্য এভাবেই বর্ণনা করছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী ভানু হাজরা।

গতকাল সোমবার ভানু হাজরার সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল প্রায় ২০ বছর।

ভাড়াউড়া গণহত্যার মাত্র ২-৩ দিন আগে তার বাবা মঙ্গু হাজরা শহীদ হন পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে। মঙ্গু হাজরা ভারতীয় সেনা সদস্যদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মৌলভীবাজারের শেরপুরে।

সেখানে ২ পক্ষের গোলাগুলির সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন মঙ্গু হাজরা। তাকে ঘরের পাশেই সেদিন মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল।

ভানু হাজরা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাঞ্জাবিদের ৭-৮ জনের একটি দল দক্ষিণ দিক থেকে এসে চা বাগানে ঢুকে। একজনকে গাঙের (চা-বাগানের খাল) কিনারে মারল। এরপর গ্রাম পুলিশকে তারা বলল, ঘরে ঘরে যত পুরুষ আছে, ডেকে আনো। তাদের দিয়ে কাজ করাব, বাংকার করাব।'

'যারা বাসা থেকে এলেন না, সেনারা তাদেরকে ধরে নিয়ে এলো। এরপর পুলের কাছে (বর্তমান বধ্যভূমির স্থান) সবাইকে নিয়ে গেল। দুশমন আসছে বলে সবাইকে খালে নামাল। এরপর সবাইকে গুলি করল। দুই পাশ থেকে গুলি করে মারল,' যোগ করেন তিনি।

ভানু আরও বলেন, 'আমরা বাগান থেকে গুলির শব্দ শুনছিলাম। ৭-৮ জন মাত্র বাঁচতে পারলেন। গুলির শব্দ শুনে সবাই বাগান ছেড়ে চলে গেলেন। সকাল ১০টা-১১টার দিকের ঘটনা ছিল এটা।'

পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পর ভানু হাজরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, খালে লাশের স্তূপ। সেদিন ৪৭ চা শ্রমিকের রক্তে লাল হয়েছিল ভাড়াউড়া চা বাগানের শাখামোড়া ছড়া সংলগ্ন (খাল) রামআড়া লাইনের মাটি।

কারো মতে, এই সংখ্যা ৫৩। ভানু হাজরা এরপর মা ও ভাইদের নিয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমলপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলায় মা সঞ্চরি হাজরা ও ভাই মনা হাজরা শহীদ হন।

অপর প্রত্যক্ষদর্শী চা বাগানের দক্ষিণ লাইনের আহত কেদারলাল হাজরার বোন জামাই লালচান হাজরা (৭৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি সেদিন বাগানেই ছিলাম। তারারে (পাকিস্তানি সেনাদের) দেখতে আছি। দূরে লেবার লাইনে আগুন জ্বলছে। এর মাঝে দেখলাম ২ জনরে ফায়ার করছে। গাঙের কাছে কালাচান, নকলা হাজরাসহ ৩ জনরে ফায়ার করতে দেখলাম। আমি চারাবাড়ির এক বটগাছের নিচে লুকিয়ে তাদের দেখতেছিলাম। দেখলাম লোকজনরে দলা (একত্র) করছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এরপর একসময় টরটর টানা আওয়াজ শুনি। সেদিন আমার অনেক আত্মীয়স্বজন মারা গেছে। এই ঘটনার পর বাগান ছেড়ে চলে যাই।'

সেদিন লাশের স্তূপ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন রমেশ হাজরা, গোলাপচান হাজরা, করমা হাজরা, ডেপুয়া হাজরা, কেদারলাল হাজরাসহ ৭ জন। তাদের কারো শরীরে গুলি লেগেছিল, কারো লাগেনি। গুলির আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। তবে তাদের কেউই আজ আর বেঁচে নেই।

গতকাল বিকেলে ভাড়াউড়া চা বাগানের বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, শ্রীমঙ্গল-ভাড়াউড়া সড়কের পাশে আকাশি রঙের স্মৃতিস্তম্ভটি দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ৩ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তবে তাৎক্ষণিক বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি বধ্যভূমি।

সেখানে রং ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে দেখা যায়। তদারকি করছেন কালীঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রাণেশ গোয়ালা।

ইউপি চেয়ারম্যান প্রাণেশ গোয়ালা ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৯৬ সালে কালীঘাট ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে স্তম্ভটি বানানো শুরু হয়। প্রতি বছর আমি নিজ দায়িত্বে রং করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করি।'

এই স্তম্ভটিকে 'চা শ্রমিকদের ত্যাগের ইতিহাসের প্রতীক' হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'অনেক চা শ্রমিক শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এখানে এসে ভক্তিও করেন। প্রতিটি জাতীয় দিবসে এখানে চা শ্রমিকদের পক্ষ থেকে শহীদদের স্মরণে ফুল দেওয়া হয়।'

মুক্তিযোদ্ধাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, '১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিলের পর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য নারী-পুরুষ তাদের হাতে নিহত হন।'

তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর শ্রীমঙ্গলে অসহযোগ আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। অফিস-আদালতসহ শ্রীমঙ্গলের চা শিল্পে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা।

ভাড়াউড়া চা বাগান এলাকায় বধ্যভূমিতে ৪৭ চা শ্রমিককে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

ভাড়াউড়া চা বাগানের কলেজ সড়কে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিসৌধ আজও এর সাক্ষী বহন করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago