মুক্তিযুদ্ধ

অপারেশন নাট ক্র্যাক: আখাউড়া দখলের যুদ্ধ

আখাউড়া যুদ্ধে ভারতীয় ট্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল গনজালভেসের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এস ফোর্সের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী ও ১১ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম। গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে যুদ্ধের নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।

তবে একটি আলোচনা বৈঠকের প্রায় পুরো সময় জুড়েই ছিল। যেভাবেই হোক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দখল নিতেই হবে। বৈঠকের এক পর্যায়ে মেজর জেনারেল গনজালভেসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহকে আখাউড়া দখলের অপারেশনে সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন। একইসঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারিও সহায়তায় থাকবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠকের শেষদিকে এসে সিদ্ধান্ত হয়, এস ফোর্সের মুক্তিবাহিনী ও ৫৭ ডিভিশনের ভারতীয় সেনারা সম্মিলিতভাবে আখাউড়া দখল করবে। অপারেশনটি করা হবে ৩ পর্যায়ে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় দখল করে আছে এই অপারেশন নাট ক্র্যাক বা আখাউড়া দখলের যুদ্ধ। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ ও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের এই ভয়াবহ যুদ্ধ ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

যে কারণে আখাউড়া দখল গুরুত্বপূর্ণ ছিল

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার অবস্থান সামরিক দিক থেকে মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় মিত্রবাহিনী এবং পাকিস্তানি বাহিনী সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একবার আখাউড়া নিজেদের দখলে নিতে পারলে মুক্তিবাহিনী সিলেট অঞ্চলের দিকে ভালোভাবে অগ্রসর হতে পারত। নয়তো ওইদিকে অগ্রসর হতে গেলে আখাউড়ায় হানাদারদের শক্তিশালী বাধার মুখে পড়তে হতো মুক্তিবাহিনীকে।

এ ছাড়া, রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট যেতে হলে এই রেলপথ অতিক্রম করেই যেতে হতো পাকিস্তানি বাহিনীকে। হানাদারদের সেনা পরিবহন, মালামাল ও রসদ সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করতে তাই এটি দখল করা জরুরি ছিল।  

মিত্রবাহিনীর কাছে আখাউড়া গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হচ্ছে, আখাউড়া ত্রিপুরার আগরতলা থেকে মাত্র ৩ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। পাকিস্তানি বাহিনী আখাউড়া থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে হামলা চালালে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত আগরতলা।

আখাউড়া দখলে রাখতে মরিয়া পাকিস্তানি বাহিনী

আখাউড়া নিজেদের দখলে রাখার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী অনেক ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল। আখাউড়ায় তারা নিয়োজিত করেছিল ২৭ পদাতিক ডিভিশনের দুর্ধর্ষ ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, ২ ইপিসিএএফ কোম্পানি, একটি ফিল্ড ব্যাটারি ও ২টি ট্যাঙ্ক ট্রুপস। এ ছাড়া গঙ্গাসাগরের দক্ষিণে রেখেছিল ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের ইপিসিএএফের ১ কোম্পানি সেনাও।

আখাউড়া যুদ্ধের নকশা। সংগৃহীত।

মুক্তিযুদ্ধের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিলোনিয়া মুক্ত হওয়ার পর ২৮ নভেম্বরের মধ্যেই এস ফোর্সের অধীনে থাকা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরিয়ে আনেন ব্রিগেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ। এরপরই আখাউড়া দখলের পরিকল্পনা করতে থাকে মুক্তিবাহিনী।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল গনজালভেসের সঙ্গে বৈঠকের পর আখাউড়া দখলে এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ প্রথমে তার অধীনস্ত ব্রিগেডের ২ ব্যাটেলিয়ন সেনা নিয়োগ দেন। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে থাকা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দেওয়া হয় মূল আক্রমণের দায়িত্ব। মূল আক্রমণের মাধ্যমে আখাউড়া থেকে সিঙ্গারবিল পর্যন্ত মুক্ত করবে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল। আক্রমণের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে আর্টিলারি সাপোর্ট দেবে মুজিব ব্যাটারি ও ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি ইউনিট।

লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় রাজাপুর ও আলীপুর গ্রামে অবস্থানরত হানাদারদের ওপর আক্রমণের।

মেজর আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বাধীন ১১ ইস্ট বেঙ্গলের সেনাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় আখাউড়া আক্রমণের পর সিলেটের দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তা ও রিইনফোর্সমেন্ট সুবিধা পুরোপুরি বন্ধ রাখার। এজন্য মেজর নাসিম মুকুন্দপুর ও হরশপুরে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন। একইসঙ্গে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন ১১ ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আগরতলা অভিমুখী হয়ে ধর্মগড়ে অবস্থান নেওয়ার।

এ ছাড়া ৩ নম্বর সেক্টর থেকে ২ কোম্পানি সেনা এনে মেজর আবদুল মতিনের নেতৃত্বে মোতায়েন করা হয়, যেন পাকিস্তানি সেনারা আগরতলার বিমানবন্দরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ওপর আক্রমণ চালিয়ে কোনো ক্ষতি না করতে পারে।

চূড়ান্ত আক্রমণ

প্রথম পর্যায়ে ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর ভারতীয় ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের ১০ বিহার রেজিমেন্টের সহায়তায় অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে নোয়াপাড়া ও লোনাসার নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় মুক্তিবাহিনী। একইসঙ্গে ৪ গার্ডস রেজিমেন্টের সহায়তায় আখাউড়ার পশ্চিম এলাকাগুলোর দখল নেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড নেয় মানাইদের দখল।

দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ ডিসেম্বর রাতের মধ্যেই সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সিঙ্গারবিল ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায় দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ।

সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। ভোর ৫টা পর্যন্ত একটানা চলার পর থেমে যায় যুদ্ধ। কিন্তু সকালে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাল্টা হামলায় মুক্তিযোদ্ধারাও আক্রমণে জোর বাড়ান। আবারও শুরু হয় ২ পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ভোর ৬টার দিকে আজমপুর রেলস্টেশনের উত্তরাংশ এবং দুপুর ৩টা পর্যন্ত চলা যুদ্ধে আজমপুর রেলস্টেশন পুরোপুরি দখল করে মুক্তিবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল। একই দিনের মধ্যে ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড আগরতলা গঙ্গাসাগর ট্র্যাক ধরে কর্নেল বাজার দখল করে নেয়।

টানা ৩ দিন যুদ্ধের পর ২ ডিসেম্বর রাতে আজমপুর রেলস্টেশন অবস্থানে পরিশ্রান্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামানের নেতৃত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। কুয়াশাভেজা রাতে কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই।

 শেষ রাতের দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থানের ওপর আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে। হতচকিত হয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা ২ দিক থেকে আক্রমণ শুরু করলে পাল্টা আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধারা। ২ পক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। ৩ ডিসেম্বর সকালের আলো ফুটতেই পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ ৪ গুণ বৃদ্ধি পায়।

পাকিস্তানি বাহিনীর এমন আক্রমণে এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়েন লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা। এক পর্যায়ে কিছুটা পিছু হটেন তারা। কিন্তু সমন্বিত আক্রমণ চালিয়ে ফের আজমপুর রেলস্টেশন নিজেদের দখলে নিয়ে নেন। এই যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামান, প্লাটুন কমান্ডার নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী খানসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

আজমপুর যুদ্ধে শহীদ লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামান, বীর প্রতীক। ছবি: সংগৃহীত

৩ ডিসেম্বর রাতে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের ২টি ব্রিগেড আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। এ সময় ভারতীয় বাহিনীর এই ২টি ব্রিগেডেই ছিল ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রন। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বিত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী টিকতে না পেরে বিমান সাহায্য চেয়ে পাঠায়। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি এফ-৮৬ স্যাবর জেট আখাউড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালাতে শুরু করে। এই হামলার জবাবে ভারতীয় বিমান পাকিস্তানি হানাদারদের বিমানকে ধাওয়া করে। তখন পাকিস্তানি স্যাবর জেটগুলো পালিয়ে যায়।

এদিন আখাউড়ার পাশে গঙ্গাসাগরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বড় যুদ্ধ হয় ভারতীয় ১৪ গার্ড ব্যাটেলিয়নের। এতে শহীদ হন ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কাসহ বহু ভারতীয় সেনা। শহীদ আলবার্ট এক্কাকে পরে পরমবীর চক্রে (ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক পদক) ভূষিত করে ভারত সরকার।

ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা পরমবীর চক্র। ছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধের এক পর্যায়ে ৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনী আখাউড়ার পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনীকে। তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। হানাদারদের সামনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। ফলে ৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে ৪ ব্রিগেড সেনাসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তারা।

৬ ডিসেম্বর আখাউড়া ডাকঘরের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী।

এই যুদ্ধের পরপরই ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মুক্ত করার জন্য অপারেশনের পরিকল্পনা হাতে নেয় মুক্তিবাহিনী। আখাউড়ার পতনের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে আর কোথাও অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র দশম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ৩

এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য/ মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.), বীর বিক্রম

Comments

The Daily Star  | English

Protests disrupt city life, again

Protests blocking major thoroughfares in Karwan Bazar and Shahbagh left the capital largely paralysed

1h ago