ঘাটারচর-ভাওয়াল গণহত্যা: প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে আজও ভাসে সেই নৃশংসতা
বাম চোখের নিচে, বাম হাতে, বুকে, ডান হাঁটুর উপরে ও নিচেসহ গোটা শরীরে মোট ৫টি গুলির দাগ। হঠাৎ করেই মাঝেমাঝে মাঝরাতে ভীষণ যন্ত্রণায় গা কাঁপতে শুরু করে তার। প্রচণ্ড বিভীষিকাময় স্মৃতি দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করলে এখনো গভীর রাতে আঁতকে উঠেন গিয়াস উদ্দিন। শারীরিক যন্ত্রণা ও দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে এভাবেই গত ৫১ বছর পাড়ি দিয়েছেন তিনি।
'মাঝ রাইতে পাকিস্তানি মিলিটারি নদী হইয়া গানবোট দিয়া খাল ধইরা আইলো। এরপর রাইতের মধ্যেই ঘাটারচর বেবাকটি ঘেরাও করল। ভোর ৬টার দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়া শুরু করল গুলি। রাজাকাররা বাড়ির থেইকা পুরুষ সবটিরে বাইর কইরা আইনা মাঠের মধ্যে লাইন ধরাইল। এরপর মিলিটারি শুরু করল গুলি। আমারেও বাড়ির থেইকা বাইর কইরা আনছিল। মিলিটারি যখন গুলি করল তখন আমি গুলি খাইয়া উপুড় হইয়া পইড়া গেলাম। হাত-পা, চোখ দিয়া খালি বানের মতো রক্ত যাইতাছে।
উঠবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। চোখ বন্ধ হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে চাইয়া দেখি মাঠের মইধ্যে আমার চাইরদিক খালি লাশ আর লাশ। ৫টা গুলি লাগল আমার শরীরে। বুঝলাম বাঁচবার পারমু না। কলমা পড়তে লাগলাম। সেদিন গেল, পরের দিন বহু কষ্টে একটা নৌকা জোগাড় কইরা আমার এক মামু আর নানা আমারে মিটফোর্ডে লইয়া গেল। হাসপাতালেও তল্লাশি করছিল আর্মিরা। মানে ওরা তুইলা নিয়া যাইয়া মাইরা ফালাইব। কিন্তু ডাক্তারেরা মিছা কথা কইয়া আমারে বাঁচাইল।'
গিয়াস উদ্দিন যখন এই নৃশংসতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন তার চোখে জল।
শুধু তিনি নন, মুক্তিযুদ্ধের ২৫ নভেম্বরের ভোর ঢাকার কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়নের ঘাটারচর ও ভাওয়াল গ্রামবাসীর জন্য এসেছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে। পুরো ঘাটারচর ও ভাওয়াল গ্রাম হয়ে উঠেছিল রক্তাক্ত প্রান্তর। মুক্তিযুদ্ধের পর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদ নগর।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘাটারচর খেলার মাঠের দখল নিয়ে স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার ফয়েজ হোসেনের সঙ্গে তীব্র বিরোধ চলছিল স্থানীয় গ্রামবাসীর।
রাজাকার ফয়েজ হোসেন জাল দলিলেও মাঠ দখল করতে না পেরে গ্রামবাসীদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এরপর তিনি ঘাটারচর গ্রামে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতির কথা জানান দিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৭ দফা নোটিশ পাঠান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ঘাটারচরের বাসিন্দা ও ইপিআর সদস্য গোলাম মোস্তফা, রহমান মাতবরসহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রহমান মাতবর বাড়িতে এসে স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আহ্বান জানান। তরুণদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য ও কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় তরুণদের নিয়ে ২৪ নভেম্বর রাতে স্থানীয় টানপাড়া মসজিদের পাশে বৈঠক করেন। বেশ কয়েকজন তরুণ তখনই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য নাম লেখান।
মুক্তিযোদ্ধাদের বৈঠকের খবর বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরে ফয়েজ হোসেন, লুটের চরের রাজাকার মোক্তার মিয়া ও রাজাকার জয়নাল ডাক্তার গোপনে পাকিস্তানি বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতির কথা জানান।
২৫ নভেম্বর রাত দেড়টার দিকে প্রায় ১৫০ জন পাকিস্তানি সেনা বেশ কয়েকটি গানবোটে করে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ওয়াশপুর ঘাটে নামে। এরপর তারা হেঁটে নদীর পশ্চিম পাশ দিয়ে ঘাটারচরের প্রান্তে উপস্থিত হয়। এরপর বোরকা পরা রাজাকার কমান্ডার ফয়েজ হোসেন ও রাজাকার মোক্তার মিয়ার সহযোগিতায় রাতের মধ্যেই গোটা ঘাটারচর গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে হানাদার সেনারা।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেসঙ্গে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা রাজাকার কমান্ডার ফয়েজ হোসেনের সহযোগিতায় বাড়ি বাড়ি প্রবেশ করে পুরুষ সদস্যদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার শুরু করে। এ সময় বিভিন্ন বাড়িতে থাকা পুরুষরা প্রাণ বাঁচাতে রুদ্ধশ্বাসে পালাতে শুরু করেন। কিন্তু আগেই গোটা গ্রাম ঘেরাও করায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন ঘাটারচর গ্রামবাসী।
এ সময় পাকিস্তানি সেনারা ঘাটারচরের টান পাড়া, পশ্চিম পাড়া, পূর্ব পাড়া, ভাওয়াল খান বাড়িসহ পুরো ঘাটারচরের বাড়ি বাড়ি থেকে পুরুষদের টেনে হেঁচড়ে ঘরের বাইরে এনে খালপাড় ও ঘাটারচর মাঠে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালায়। মুহূর্তেই শহীদ হন ৫৭ জন নিরীহ গ্রামবাসী।
ঘাটারচর গণহত্যায় ২ ভাই আরজ আলী ও দরবেশ আলীকে হারালেও ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন শমসের আলী।
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সকাল ৮টার দিকে আমাদের বাড়িতে ঢুকল পাকিস্তানি আর্মি। ঘরে আমরা ভাইবোনরা ছিলাম। ওরা আমার বড় ভাইকে বাড়ি থেকে টেনে বের করে গেটের সামনে ব্রাশফায়ার করে মারল। আরেক ভাইকে মাঠে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারল। বড় ভাইকে যখন ব্রাশফায়ার করে মারল তখনই আমি প্রাণ বাঁচাতে ছুটে গিয়ে বাড়ির পাশের জঙ্গলে লুকালাম। ওরা আর আমাকে দেখতে না পাওয়ায় বেঁচে গেলাম।'
শমসের আলী আরও বললেন, 'ঘাটারচরে আমরা কেবল একটি গণকবরেই ৩৪ জন মানুষকে একসঙ্গে মাটিচাপা দিয়েছিলাম। চারদিকে তখন শুধু মরদেহ আর মরদেহ। কয়জনের জন্য আর কবর খুঁড়ব। তাই গণকবর খুঁড়েই দাফন করেছিলাম।'
ভোর ৬টায় শুরু হওয়া ঘাটারচর গণহত্যা শেষ হয় সকাল ৮টায়। এরপর আনুমানিক সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পায়ে হেঁটে ঘাটারচরের পাশে ভাওয়াল গ্রামের সড়কে এসে উপস্থিত হয়।
প্রথমে পাকিস্তানি সেনাদের বড় একটি দল ভাওয়াল স্কুলের পাশ দিয়ে প্রবেশ করে গ্রামের উত্তর ও পশ্চিম দিক পুরোপুরি ঘেরাও করে ফেলে। এরপর বাকি হানাদার সেনারা গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবেশ করে। পাকিস্তানি সেনাদের দেখতে পেয়েই ছুটতে শুরু করেন গ্রামবাসী। এ সময় রাজাকাররা গ্রামবাসীদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না বলে আশ্বস্ত করে বাড়িতে থাকতে বলে।
বেশিরভাগ গ্রামবাসী পালিয়ে গেলেও অবশিষ্টরা রাজাকারদের কথা বিশ্বাস করে বাড়িতে যান। তাদের তখন শান্ত হয়ে বসতে বলে রাজাকাররা। গ্রামবাসী বসামাত্রই ব্রাশফায়ার শুরু করে হানাদার সেনারা। নির্মমভাবে শহীদ হন ২৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী।
ভাওয়াল গণহত্যায় অমর চান হারিয়েছেন তার পরিবারের ৭ সদস্যকে। ভাওয়াল গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। ভাগ্যক্রমে সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও আজও তার চোখে ভাসে হানাদার ও রাজাকারদের নির্মমতার পৈশাচিক দৃশ্য।
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সকাল ৮টা-সাড়ে ৮টা হইব। দেখলাম মিলিটারি আর মুখে গামছা বাঁধা কয়েকজন সড়ক দিয়া যাচ্ছে। আমরা সবাই খালপাড় দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। গিয়া দেখলাম ওরা স্কুলের পাশ দিয়া ঘেরাও করছে। তখন রাজাকারর আমগোরে ফিরাইল। রাজাকাররা বলল, আপনারা বাড়িত যান আপনাগো কোনো ক্ষতি হবে না।'
আমরা বাড়িতে গিয়ে বসার সঙ্গেসঙ্গে শুরু করল গুলি। ওরা যখন ব্রাশফায়ার শুরু করল তখন আমি আমার ক্ষণিকের মধ্যেই বড় পোলারে কোলে নিয়া খালপাড় দিয়া পলাইলাম। আর আমার বউ আমার ছোট পোলারে নিয়া উত্তর দিকে দৌড় দিলো। গুলি খাইয়া আমার বাপ, বোন, বোন জামাই, ছোট ভাই, ভাগ্নি, ভাইগ্নারা পলাইতে পারে নাই।
আমরা যখন কিছুক্ষণ পর বাড়ির দিকে আসলাম। বাড়ির আসতে গিয়া দেখি কাছের একটা আমগাছের সামনে মিলিটারি খাড়া। এখন যদি আমি দৌড় দিই তাহলে মাইরা ফালাইতে পারে। আমি হাত উঁচু করতে ওরা বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করল। শেষে ওরা আমারে ছাইড়া দিয়া ভাগতে কইল। আমরা ভাইগা গেলাম বন্দের হাফাড়। কপালের জোরে বাইচা গেলাম। সেদিন আর বাড়িত আইলাম না। পরদিন সকালবেলা আইয়া দেখি সব লাশ পইড়া রইছে একখানে। আমার বাপের লাশটা আধা মাইল দূরে গিয়া খুঁইজা পাইলাম। সেদিন পাশের বাড়ির ২ জন মিলে মোট ৯ জনের লাশ দাফন করলাম বাড়ির সামনে।'
ভাওয়াল গ্রামের গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন অমর চানের বাবা, বড় বোন, বড় বোনের স্বামী, ছোট ভাই, ২ ভাগ্নে ও ১ ভাগ্নি। তার বোন বিষকা রানীর শরীরে ৭টি গুলি লাগলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
নির্মমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে অমর চানের চোখে জল আসে।
তিনি বলেন, 'আমার বাবারে কিন্তু একটা গুলিও করে নাই। বেয়নেট দিয়া খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া মারছে। শরীরে ৪ জায়গায় গর্ত দেখতে পাইলাম। আমার ছোট বোনের গায়ে ৭টা গুলি লাগলেও সেদিন বাঁইচা গেছে।'
এই গণহত্যায় বড় ভাওয়াল ঋষিপাড়ার বাসিন্দা ভারতী রাণী হারিয়েছিলেন তার স্বামী রামচরণ ও পিসতুতো ভাই যুদ্ধু দাসকে।
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আগের রাতে আমি আর আমার পিসতুতো ভাই বাপের বাড়ির থেইকা আসছি। সকাল বেলা মিলিটারি দেইখা আমরা বেবাকটি দৌড়াইলাম। ওরা মারুম না কইতে কইতে সবটি থাইমা গেল। তখন বেবাকরে খালপাড়ে আইনা জড়ো করল। এরপর গুলি শুরু করল। আমার স্বামীর ২ পায়ে দুইটা গুলি লাগছিল। তিনি মরার ভান ধরে পইড়া আছিলেন যেন মিলিটারি বা রাজাকারেরা জিন্দা আছে বুঝবার না পারে। আমরা কয়েকজন পালাইতে পারলাম। মিলিটারি যখন চইলা গেল তখন বাড়ির থেইকা কেউ কেউ আইসা খবর দিলো, তোমার স্বামী আর তোমার পিসতুতো ভাইরে তো মাইরা ফালাইছে। আমরা দৌড়াইয়া বাড়িত আইসা দেখি আমার স্বামীরে কয়েকজন ধইরা হাসপাতালে লইয়া যাইতাছে।
শাশুড়ি হাসপাতালে গেলেও আমি যাই নাই। হাসপাতালে যাওয়ার পরে রাজাকাররা যখন আমার শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলো আপনারা কই থেইকা আইলেন? আমার শাশুড়ি যখন কইল আটি ভাওয়াল। তখন রাজাকাররা কইল যেই জায়গায় মানুষ মারলাম হেই জায়গা থেইকাই আইলো। পরদিন আমার শাশুড়ি বাড়ির থেইকা ভাত নিয়া গিয়ে দেখে আমার স্বামী বিছানায় নাই। রাজাকাররা নিয়া মাইরা ফালাইছে। লাশটাও আর পাই নাই। পিসতুতো ভাই ও পাশের বাড়ির যারা মরল তাগোরে নিয়া মোট ১১ জনরে বাড়ির সামনে গর্ত খুঁইড়া আমরা মাটি চাপা দিলাম।'
ঘাটারচর আর ভাওয়ালে গণহত্যা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও সহযোগী রাজাকাররা। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাশের কাঁঠালতলী ও গুইটা গ্রামে আগুন লাগিয়ে বেশিভাগ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল হানাদার বাহিনী।
Comments