বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন রাজনীতি চাই
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এতো মানুষ চিন্তা করেছেন যে, তাদের ভাবনারাশি সমুদ্র উপচে পড়বে। কিন্তু চিন্তাগুলো সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু হয়নি। এর পেছনে মূল কারণ রাজনৈতিক দলদাসত্ব। খুব জটিল কথা নয়, দলীয় রাজনীতিই সকল নষ্টের মূল। এ কারণেই বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়-চিন্তা বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে। শিক্ষকতার দুই দশকে এতো নোংরামি দেখেছি, বলার ভাষা নেই। যখনই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইতিবাচক কিছু ভাবতে গেছি পশ্চাতে কুড়াল মেরেছে শিক্ষক রাজনীতি। অন্যদিকে ছাত্রদের কল্যাণের কথা যতবার ভেবেছি, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্ররাজনীতি।
রাজনৈতিক মতাদর্শ সমস্যা নয়, সমস্যা এর নামে তৈরি কৃত্রিম সঙ্কট। যে-কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ নস্যাৎ করে দিতে পারে তা। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানচর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্র না হয়ে ক্রমশ অধঃপতিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক ও ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করুন, ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকবে কি না! একবাক্যে উত্তর আসবে, 'না'। কিন্তু রাজনৈতিক ঝান্ডাধারী শিক্ষক ও ছাত্ররা কখনোই চায় না—রাজনীতি বন্ধ হোক।
কী কারণ এসবের পেছনে? জটিল কিছু? মোটেও না। কীভাবে নিজেদের আধিপত্য রক্ষা করা যায়, হল দখল নেওয়া যায়, সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে ছাত্রশিক্ষকের অধিকার হরণ করা যায়—এই হচ্ছে তাদের রাতদিনের পরিকল্পনা। আর তারা যদি কোনো উদ্যোগ নিতে চায়, সবাই তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারা উপস্থাপনযোগ্য এমন কোনো নজির স্থাপন করতে পারেনি, যার মাধ্যমে তাদেরকে বিশ্বাস করা যায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ-বলয় অতিক্রম করে একজন সাধারণ ছাত্র বা সাধারণ শিক্ষকের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সাধ্য নেই।
স্বাধীনতার পর এতো বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও আবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। দিনে দিনে ছাত্র হলগুলো হয়ে উঠেছে নিপীড়কদের অভয়াশ্রম। অছাত্র ও রাজনৈতিক মাস্তানদের দখলদারিত্ব সর্বব্যাপী। ফলে হলগুলোতে থাকার সুন্দর ব্যবস্থাপনা ইতোমধ্যে নষ্টই হয়ে গেছে। একজন ছাত্র ভালো পরিবেশের অভাবে শান্তিমতো লেখাপড়া করতে পারে না। এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষাজীবনের সর্বত্র। এমনকি পাশ করে যাবার পরেও কর্মজীবনের বিভিন্ন সেক্টরে প্রবেশ করে দেশপ্রেমের যে অভাব পরিলক্ষিত, সেটাও এই কলুষিত পরিবেশের ফল বলে মনে করি।
ছাত্র হলে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কী ধরনের কর্মকাণ্ড চলে, তা বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট। মুখের ওপর কেউ কিছু সাহস করে বললেও, তারা নির্লজ্জ ও বেহায়ার মতো আচরণ করে। প্রতিবাদ করলে প্রতিক্রিয়া হয় নানারকম—হয়তো আরামসে মাথা নেড়ে হেসে উড়িয়ে দেবে, না হলে দেখে নেবার হুমকি দেবে অথবা সব শুনবে কিন্তু করবে না কিছুই। আর যা করবে তা একান্তভাবে তাদের মতোই, কেউ কিছু জানার বা বোঝার সুযোগই পাবে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিন্দুমাত্র বালাই নেই। এর অপর নাম একগুয়েমি ও স্বার্থপরতা, যা স্বৈরশাসনের চরম সহায়ক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে ভিলেজ পলিটিকসের কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু একটা সভ্য সমাজ তৈরি করতে হলে নতুন পলিসি দরকার। স্বায়ত্তশাসন হরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আপাদমস্তক রাষ্ট্রের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠান করে তোলা হয়েছে। কিন্তু এখানে শুধু রাষ্ট্র নয়, আইএমএফের ফর্মুলায় অর্থায়নও নয়, যে-কোনো রকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ইউজিসি নামক একটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহারাদার করে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে এটা অকার্যকর একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
দেশের সরকারের কাছে দাবি, অচিরেই শিক্ষাকমিশন গঠন করে বিদ্যমান অসঙ্গতিসমূহ দূর করা হোক। একবার ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে পরিকল্পনা-অনুযায়ী কাজে হাত দিন। দেখবেন, বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সময় লাগবে না।
কথা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত মানোন্নয়ন করতে হলে বিদ্যানুরাগী, জ্ঞানান্বেষী, ছাত্রবান্ধব শিক্ষকদেরকে সামনে আনতে হবে। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থীদেরকে কাজে লাগাতে হবে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে তার নিজস্ব চরিত্র ফিরিয়ে দিতে হবে। দক্ষ ও উপযুক্ত জনশক্তি তৈরি ও ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজগুলো সুসম্পন্ন করার সুযোগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্নরকম দাপ্তরিক কাজগুলোতে কতটা অবহেলার ছাপ রয়েছে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
একাডেমিক কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, বিশ্বমানের গ্রন্থাগার, গবেষণা ও জ্ঞানার্জনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা তো সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয় কমিউনিটির জন্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও যুগোপযোগী ও কার্যকর করা উচিত। সর্বোপরি মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলো যাতে সুুন্দরভাবে পরিচালিত হয়, সেরকম পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। আর এসবই ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা রয়েছেন সবাই জানেন, কেবল কাজটা হয় না।
দেশের সরকারের কাছে দাবি, অচিরেই শিক্ষাকমিশন গঠন করে বিদ্যমান অসঙ্গতিসমূহ দূর করা হোক। একবার ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে পরিকল্পনা-অনুযায়ী কাজে হাত দিন। দেখবেন, বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সময় লাগবে না।
একটি ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু সেসব হতে হবে সুচিন্তিত, সুদূরপ্রসারী। কাজে ও কর্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বৃদ্ধি করবে এমন প্রসঙ্গই কেবল আসতে পারে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু করার আছে, জাতিকে অনেক কিছু দেবার আছে, যার পরিকল্পনা আগে থেকেই গ্রহণ করা উচিত। আজ ও আগামী দিনের প্রবর্ধমান ক্যাম্পাসের মূল স্পিরিট যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, সেদিকে কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজর দেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে রয়েছে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব। যেমন :
(১) প্রত্যেকটা অনুষদের জন্য স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান দরকার। বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে তা একস্থান থেকেও হতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কলা-মানবিক এবং সমাজবিজ্ঞান অনুষদের গবেষণা উন্নয়নের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার জন্যও ব্যবস্থা অপ্রতুল। অন্যদিকে চিন্তাশীল, অগ্রবর্তী, চৈতন্যসম্পন্ন মানুষ তৈরির জন্য সমাজবিজ্ঞান, কলা ও মানবিকবিদ্যা বিকাশের বিকল্প নেই। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্যই মানুষের মনন ও চৈতন্যের বিকাশ জরুরি।
(২) বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নের জন্য যথোপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। পুরনো শিক্ষকদের পাশাপাশি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এতে উপকৃত হবেন। গবেষণা-কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পারস্পরিক শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেয়া শিক্ষকের সংখ্যা প্রচুর। তাদের অর্জনকে নিজের দেশে কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। এমনকি দেশেই ভালো মানের গবেষণা ও মাঠপর্যায়ে কর্মের মাধ্যমে দেশকে কিছু দেওয়ার মনোভাবকে জাগ্রত রাখা যেতে পারে। প্রয়োজনে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক ও প্রশিক্ষক সাময়িক সময়ের জন্য অন্য দেশ থেকে আনা যেতে পারে।
(৩) সুস্বাস্থ্য ছাড়া সুন্দর জাতি তৈরি হতে পারে না। সুস্বাস্থ্যের জন্য সুখাদ্য জরুরি। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের খাদ্য-ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো দরকার। হলগুলোতে যথেষ্ট মনিটরিং-এর মাধ্যমে ডাইনিং চালু রাখা এবং খাবারের মান বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন। ছাত্রছাত্রীদের আবাসগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষার জন্য, স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য তাদেরকে উজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি ছাত্র যেন শিক্ষাজীবনের প্রথমদিন থেকে ভালো আবাসন পায় সেদিকে কড়া নজর দিতে হবে।
(৪) সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন সুখাদ্য, তেমনি অসুখের জন্য দরকার ভালো চিকিৎসা। শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত স্বাস্থ্যসেবা এখন সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে যে চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে তার সেবার মান নিয়ে তেমন কেউই সন্তুষ্ট নন। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অত্যাধুনিক সেবা-সুবিধা সম্বলিত হাসপাতাল নির্মাণ করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু রাষ্ট্রের কাছে নেবে না, তাকে কিছু দেবার জন্যও অগ্রণী হতে হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছেও তা চমৎকার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।
(৫) প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটকে পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। শুধু ভাষার ডিপ্লোমা নয়, গ্রাজুয়েট ডিগ্রিও যাতে কেউ নিতে পারেন সে ব্যবস্থা থাকা উচিত। বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের ছাত্রদের ভাষার কোর্সে ভর্তির জন্য প্রণোদনা তৈরি করা উচিত। পারলে তাদের ব্যাচেলর প্রোগ্রামের সঙ্গেই ভাষার কোর্স অধিভুক্ত করা দরকার। বর্তমান বিশ্বে ভাষা এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ঐতিহ্যবাহী ও কর্ম-উপযোগী কয়েকটি ভাষা শেখার উপযুক্ত ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই হতে পারে। ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন দেশে অধিকতর উচ্চশিক্ষার জন্য গেলে তা অত্যন্ত কাজে আসবে। এমনকি বিদেশিদেরকেও আমাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে আগ্রহী করে তোলার আকর্ষণীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। জাতি হিসেবে অন্যের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে স্বভাষা ছাড়া পথ নেই।
(৬) বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস-কার্যক্রম এখনো মান্ধাতা আমলের। বিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রতিধ্বনি শোনা গেলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা এখনো সেকেলে পর্যায়ে। কাজেকর্মে নানা ধরনের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা বিষফোঁড়ায় পরিণত। সে তুলনায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরং গতিশীল। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্ট্রাল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম, সফটওয়ার ও অ্যাপস ব্যবস্থাপনা এখনও কেনো দূরবর্তী তা বোধগম্য নয়। বিভিন্ন বিভাগের একাডেমিক কার্যক্রম, উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা-সম্বলিত শ্রেণিকক্ষ, এমনকি ফল প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়া এখনো সেকেলে পর্যায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়কে গতিশীল করতে সময়ের অপচয় রোধ করার উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখনই জরুরি।
(৭) সম্পদ-ব্যবস্থাপনায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়। সিস্টেম লসের পাল্লায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ, পরিবহন, বর্জ-ব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ প্রক্রিয়া। সিস্টেম লস কমিয়ে অধিক সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃত্তি প্রদান করা যেতে পারে।
(৮) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। এই খাতে অর্থের অপচয় রোধ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কোনো কোনো ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলোতে পাবলিক পরিবহন দূষণের পরিমাণ ভয়াবহ রকমের। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটরবাইকের উৎপাতে রাস্তা চলাই দায়। এই বিপর্যয়কে ঠেকাতে না পারলে অচিরেই ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অনুপযোগী হয়ে উঠবে। মূল রাস্তাগুলোতে লেনের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়াও নির্বিঘ্নে হাঁটার জন্য ফুটপাত তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন।
(৯) ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই প্রাইভেট টিউশানি তথা অর্থ-রোজগারের জন্য বিভিন্ন স্থানে গমন করে। কেউ শুধু জীবিকার তাগিদে পার্ট টাইম কাজ হিসেবে টিউশানিকে বেছে নেয়। এতে করে ছাত্রদের পড়াশুনা ও জ্ঞানবিকাশের মূল্যবান সময় সঙ্কুচিত হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষা নিতে আসা ছাত্ররা যেন ক্যাম্পাসভিত্তিক কোনো পার্ট টাইম কাজে যুক্ত হতে পারে। এর ধরন ও বাস্তবায়ন কেমন হবে তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চিন্তা করে দেখতে পারে। তাদের মেধামনন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। দেশের এতো এতো পয়সা ব্যয় যেন ভবিষ্যতে দেশগড়ার কাজে লাগে। বলতে খারাপ শোনালেও সত্য—অনেকেই অর্থ-উপার্জনের জন্য রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি থেকে শুরু করে নানা রকম কথিত-অকথিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ছাত্রজীবনেই যদি কেউ সততার সঙ্গে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা, পরিশ্রমের মানসিকতা আর কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেলে, তার পক্ষে জাতির সেবা করা অসম্ভব।
(১০) বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবহৃত স্থানসমূহ নিয়ে এখনই ভাবার সময়। ভবিষ্যতে কোথায় রাস্তা হবে, কোথায় স্থাপনা হবে, কোথায় কী ধরনের বৃক্ষরোপিত হবে সেসব নির্ধারণ করা জরুরি। পরিবেশ রক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি মান্যতা, কর্ম-পরিবেশমুখর, জ্ঞান-অর্জনে উৎসাহী করে ছাত্রদের গড়ে না তুললে সমূহ ক্ষতি। কেবল নামে বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু রাষ্ট্র-সমাজ ও মানুষের কাজে আসে না, এমন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া আত্মবঞ্চনা ক্রয় করার নামান্তর।
সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকায় সংযুক্ত হওয়া উচিত মানুষের জন্য সংবেদনশীলতা, যৌথতা, সামাজিক চৈতন্য ইত্যাদি। সীমিত আকারে ছাত্র ও শিক্ষকদের কিছু যৌথ সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রচলিত আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া দরকার। কারিকুলামের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে 'সোশ্যাল ওয়ার্ক' অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক উন্নত এমনকি উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা কার্যক্রমে এই মডেল চালু রয়েছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সরকারকে বোঝাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকদের সমৃদ্ধ করা, উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং চিন্তার পথ-প্রসারে অগ্রণী হওয়ার রাজনীতিই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি হওয়া উচিত। উপলব্ধির সময় এসেছে যে, নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে হলে সঠিক পথ অবলম্বন করতে হবে। আমরা কেউই চিরকাল বেঁচে থাকবো না। আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ আমাদের হাত দিয়েই তৈরি হতে পারে।
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments