ভয়াবহ সংকটে শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ক
দম বন্ধ করা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। কেবল জুলাই থেকে নয়, বেশ কয়েক বছর। এমন এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। অফিসে ভয়, আদালতে ভয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়। বিরোধী রাজনৈতিক দল সমাবেশ করতে না পারা, জনগণ ভোট দিতে পারেন না, স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারেন না। সরকারের সমালোচনা করলেই ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশি হয়রানি, হুমকি, হত্যা, গুম তো আছেই। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়ে দেশটা স্বাধীন করেছেন কি রাষ্ট্রকে আমলা-পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত করার জন্য?
মাসের বেশি সময় চলমান কোটাকেন্দ্র করে বৈষম্য আন্দোলনটি যে গণঅভ্যুত্থান ঘটালো, সেটি দেশের ইতিহাসে বিরল। এর নানা দিক নিয়ে আলোচনা হবে, বিশ্লেষণ হবে, গবেষণা হবে। এ আন্দোলনের নানা তথ্য-উপাত্ত, বাস্তবতা, তাগিদ, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলো এখনো আলোচিত হয়নি। সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের পোস্ট দেওয়া হয়েছে এবং ছাপা ও অনলাইন পত্রিকায় অনেকইে কলাম লিখেছেন এবং লিখবেন। তবে কোন বড় ঘটনা নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়নের জন্য অপক্ষো করতে হয়। সকল তথ্য উপাত্ত হাতে আসার পরে ওই ঘটনার অভিঘাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের কতটা উপকার হয়েছিল, বা আন্দোলনের কোন সীমাবদ্ধতা ছিল কি না-- ইত্যাদির আলোকে ইতিহাসে তার মূল্যায়ন হয়।
যাই হোক, এই আন্দোলনকে ঘিরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, কয়েক দশকের গতিপ্রকৃতি, আন্দোলন পরবর্তী সময়ের কিছু আশংকা ব্যক্ত করব। প্রথমে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও সরকারি তরফে শুধু নির্বিকার আচরণই নয়, বৈরিতা যেমন লক্ষ্য করা গেছে, তেমনি লক্ষ্য করা গেছে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যও। ফলে, সরকার সমর্থক শিক্ষকেরা এ আন্দোলনকে সমর্থন করেননি এবং অনেকেই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সরকার সমর্থকদের মধ্যে অনেকে নৈতিক ও যৌক্তিকভাবে শিক্ষার্থীদের দাবি সমর্থন করলেও, তারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। এর বাইরে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষক ভয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষক ছিলেন নিষ্ক্রিয়। অল্প কয়েকজন সাহস করে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাশে ছিলেন। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি দৃঢ়তা কারণে উঁচু আসনে আসীন হয়ে গেছেন। সহকর্মী হিসেবে আমার গভীর শ্রদ্ধা।
১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা শুরু হয়, ১৬ জুলাই থেকে পুলিশের হামলা, গুলি, আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাসপাতালে ঘোরা, পুলিশের ভয়ে শত শত শিক্ষার্থীর পালিয়ে বেড়ানো, এই সময়টাতে শিক্ষার্থীরা চেয়েছিলেন অভিভাবক হয়ে শিক্ষকরা তাদের পাশে থাকবেন। তারা চেয়েছিলেন অনেকগুলো প্রাণ ঝরে যাবার পরে শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে আসবেন। কিন্তু শিক্ষকদের পাননি পাশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষক ছিলেন নিষ্ক্রিয়। অল্প কয়েকজন সাহস করে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাশে ছিলেন। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি দৃঢ়তা কারণে উঁচু আসনে আসীন হয়ে গেছেন। সহকর্মী হিসেবে আমার গভীর শ্রদ্ধা। কিন্তু এখন একের পর এক উপাচার্য পদত্যাগ করছেন। চুপ থাকা শিক্ষক আজকাল কিছু বললেও কঠিন সময়ে নিরব ছিলেন। এরা কীভাবে ক্লাসে কীভাবে দেখাবে মুখ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লজ্জাজন্ক ঘাটতি অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়নি। এ দুটি পুরনো পাবলিক বা জন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের উপস্থিতি প্রশংসনীয়। তবে বিউপি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ এ আন্দোলনকে যেমন ব্যাপকতা দিয়েছে, তেমনি এটিকে নিয়ে গেছে তৃণমূল পর্যায়ে। ধীরে ধীরে সারা দেশের সকল মানুষের সমর্থন পেলেও, অনেক শিক্ষকের সমর্থন কেন পেল না, সেটি আশ্চর্য এক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে অনুপুঙ্খ ব্যবচ্ছেদ দরকার। বিশেষ করে ঢাকা বিশ^দ্যিালয়ের শিক্ষকদের আত্মসমালোচনা দরকার বলে আমি মনে করি।
শিক্ষকেরা যদি সারাক্ষণ বলতে থাকেন যে, 'তারা হচ্ছেন জাতির বিবেক'; তাহলে সেটি তাদের পান্ডিত্য, সততা, নৈতিকতা, আচরণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রমাণ করতে হবে। নইলে তাদের দাবিটি হাস্যকর ও অর্থহীন হয়ে দাড়াবে। শিক্ষকেরা (সবাই না) যদি নানা রংয়ের রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে পদ-পদবীর জন্য তোষামদে ব্যস্ত থাকেন, সুযোগ সুবিধার জন্য রাষ্ট্রীয় অন্যায়, অবিচার, ও জুলুমের ব্যাপারে চুপ করে থাকেন অথবা এগুলোর প্রতি সমর্থন জানান, তাহলে একজন অন্ধ এ্যাকটিভিস্ট এবং একজন শিক্ষাবিদের মধ্যে তফাৎ কোথায়?
জাতির বিবেক হয়ে ওঠার জন্য যে সকল বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন হয়, তার সবগুলোই আমরা ষাটের দশকে জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দেখেছি। নব্বুই-এর সামরিক স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত জ্ঞানে, ব্যক্তিত্বে ও প্রভাবে শিক্ষকদের সমাজে ও রাষ্ট্রে ভিন্ন রকম অবস্থান ও সম্মান ছিল।
নব্বই দশকের শুরু থেকে বিশ্বদ্যিালয়গুলো নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, এমন কি ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও প্রতিপক্ষ ছিল চিহ্নিত ও কমন। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ ছিলেন পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও শাসকদের বিরুদ্ধে। ৯০-এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ডান-বাম ও মধ্যপন্থী বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সবগুলো ছিল সামরিক স্বৈরাচারের পতনের আন্দোলনে সহযোদ্ধা। ফলে বিশ্বদ্যিালয়গুলোতে সকল শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রায় সকল শিক্ষক একাত্ম হয়ে গেছেন এবং একটি পর্যায়ে শিক্ষকেরা দলমত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন।
কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন বড় একটি দল ক্ষমতায় গেল, ওই দলের সমর্থক শিক্ষকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন এবং সরকারের ন্যায়-অন্যায় সকল কর্মকান্ডে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেলেন এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে মিছিলে নিয়ে যেতে লাগল। ১৯৯৬ সালে আরেকটি বড় দল ক্ষমতায় এলে এই দলের সমর্থক শিক্ষকেরাও একই কাজ করতে শুরু করলেন।
সাধারণ শিক্ষার্থী, জনগণ ও নানা পেশার মানুষেরা দেখলেন যে, অধিকাংশ শিক্ষকের আনুগত্য হয় এই দল, নয় তো ওই দলের প্রতি। এদের দল নেতারা উপাচার্য ও রাষ্ট্রের নানা পদে যাওয়ার জন্য নীতি-নৈতিকতা ও শিক্ষকসুলভ বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা তোষণ ও নানা রকম দুর্নীতিতে ব্যস্ত। ফলে জন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপকেরা তাদের পান্ডিত্য, উঁচু নৈতিকতা, সাহস ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য এক সময় সমাজের 'বাতিঘর' বলে যে সম্মান পেতেন, সেই জায়গাটি ভেঙ্গে পড়ল। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীসহ সকল মানুষের আস্থা হারাতে শুরু করলেন।
ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির বিপক্ষে নই। কেননা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই তো একটি দেশের আসল বুদ্ধিজীবী এবং সবচেয়ে সাহসী ও জাগ্রত অংশ। এ যাবৎ যত আন্দোলন ও সংগ্রাম হয়েছে, তার অগ্রভাগে ছিলেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্প্রতি ইসরাইলের গণহত্যা নিয়ে যে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হচ্ছে এবং হয়েছে, সেটিই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসল সত্তা। এর সাথে বা আগে আছে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রামাণিক গবেষণা। কিন্তু বাংলাদেশে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আর গবেষণার গুরুত্ব তো সরকার বুঝতই না। ফলে এটি হয়ে উঠেছিল একটি আমলাতান্ত্রিক পুলিশি রাষ্ট্র যেখানে লুন্ঠনকারীরা হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কথা হচ্ছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করবেন আদর্শ ও মূল্যবোধের রাজনীতি। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি ও পদ-পদবী পাওয়ার রাজনীতি গত তিন দশকে তাদের সর্বনাশ করেছে। এটিতে ইস্তফা না দিলে তাদের অবস্থা নাজুক থেকে নাজুকতর হবে। বিশেষ করে পাবলিক বা জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শিক্ষা-দীক্ষা ও গবেষণার মধ্য দিয়ে যেমন দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলবেন, তেমনি প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়ে জাতিকে পথ দেখাবেন।
সামগ্রিকভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্পর্কের মধ্যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। অভিভাবকসুলভ আচরণ না পেয়ে শিক্ষার্থীরা হতাশ। বিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার পরে এই হতাশার কিছু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশংকা করছেন অনেকে। প্রত্যাশা থাকবে, সবাই সহিষ্ণুতা ও সংযমের পরিচয় দেবেন। শিক্ষকদের বুঝতে হবে যে, শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে বিপদে-আপদে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা।
Comments