নেত্রকোণায় তিন দিনব্যাপী বাউল সাধক 'জালাল মেলা'
প্রখ্যাত মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁর আবির্ভাব দিবস ছিল ২৫ এপ্রিল। এ উপলক্ষে সেদিন বিকেল থেকে তার নিজ উপজেলা নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় শুরু হয় তিন দিনব্যাপী জালাল মেলা।
কেন্দুয়া উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে পৌরশহরের জয়হরি স্প্রাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে গতকাল শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত চলে এ অনুষ্ঠান।
তাত্ত্বিক কথাসহ গানে গানে মহাজন জালালের বাণী আওড়ে তাকে স্মরণ করেছেন ভক্ত–অনুসারীরা। কয়েক হাজার ভক্ত, অনুসারী ও অনুরাগীরা সমবেত হয়ে প্রাণচঞ্চল করে তুলেন প্রায় তিন একর আয়তনের মেলা প্রাঙ্গণ।
মেলার মঞ্চে বাউলসংগীত, লোকজ নৃত্য, পুতুল নাচ, লাঠিখেলা, পালাগান ছাড়াও প্রাঙ্গণে বসে লোকজ ঐতিহ্যের নানা স্টল। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলা, চরকি, ট্রেন, নৌকাসহ নানা আয়োজন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধান অতিথি হয়ে মেলা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার। মুখ্য আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট চিন্তক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদারের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন লেখক ও প্রাবন্ধিক মাসুদ সিদ্দিকী, জালাল খাঁর দুই প্রপৌত্র (নাতি) প্রাবন্ধিক গোলাম ফারুক খান ও প্রাবন্ধিক গোলাম মোরশেদ খান, লোক গবেষক সাইমন জাকারিয়া, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাফিকুজ্জামানসহ আরও অনেকে।
এরপর গভীর রাত পর্যন্ত চলে প্রখ্যাত বাউলশিল্পী সুনীল কর্মকর্তা, কুদ্দুস বয়াতী, বাউল সালাম সরকার, হবিল সরকারসহ বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে জালালের আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব, লোকতত্ত্বসহ বিভিন্ন তত্ত্বমূলক গান।
পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় 'গণমাধ্যমে জালাল খাঁ: মনোসামাজিক প্রেক্ষাপট' বিষয়ক আলোচনা। অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন ইউএনও এমদাদুল হক তালুকদার। বক্তব্য দেন বিশিষ্ট লোকগবেষক সুমন কুমার দাশ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুস সামাদ, সহযোগী অধ্যাপক এইচএম সাইদুর রহমান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আসিফ বিন আলী, কবি ও গবেষক পিয়াস মজিদ, প্রথম আলোর প্রতিনিধি পল্লব চক্রবর্তী প্রমুখ।
পরে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কুদ্দুছ বয়াতী, সালাম সরকার, গোলাম মৌলাসহ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশিত জালালের গান। মঞ্চস্থ করা হয় জালাল খাঁর জীবনী নিয়ে নাটক 'মানুষ রতন'। স্থানীয় জমিলা মমোরিয়াল বিদ্যানিকেতনের শিক্ষার্থীরা নাটকটি পরিবেশন করে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দৃশ্য সবার নজর কাড়ে।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় 'পূর্ব ময়মনসিংহের মালজোড়া বাউলগান ও জালাল খাঁ' নিয়ে আলোচনা করেন লোকগবেষক আলী আহাম্মদ খান, লেখক মোস্তাফিজুর রহমান খান, নেত্রকোনা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কবি ও প্রাবন্ধিক সরোজ মোস্তফা, লোকগবেষক সঞ্জয় সরকার, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাফি উল্লাহ প্রমুখ। গভীর রাতে জালাল খাঁর গানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ তিন দিনের অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠান মঞ্চটি বাঁশের কুলা, ঝাপি, খালই, ঘুড়ি, পলো, চাটাই, চালুন, পাখির বাসাসহ লোকজ সংস্কৃতির আবহের তৈরি করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও জালাল মেলা উদযাপক কমিটির সদস্য সচিব মো. রাজিব হোসেন।
মেলা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন লেখকের লেখা নিয়ে 'ভাবতরঙ্গ' নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। মেলায় যোগদেয়া মানুষের জন্য নিদৃষ্ট স্থানে রাখা পানি, চিনির খেলনা, কদমা, বিন্নধানের খই, ভাজা চিড়া, খাজা, গজা, মওয়া মুড়কি, বাতাসা, নিমকিসহ বাহারি লোকজ খাদ্যসামগ্রীর সমাহার নজড় কাড়ছে।
মেলায় দ্বিতীয় দিন ঘুরতে আসা কলমাকান্দার বাসাউড়া গ্রামের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক রাজন সাহা বলেন, '১৯৭২ সালে ৭৮ বছর বয়সে বাউল সাধক জালাল খাঁ প্রয়াত হন। দীর্ঘদিন পর এত বড় পরিসরে এই অঞ্চলে জালাল মেলা শুরু হয়েছে শুনে দেখতে এলাম। মেলায় নতুন প্রজন্মের কাছে জালাল খাঁকে তুলে ধরাসহ বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ ঐতিহ্য তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়ায় স্থানীয় ইউএনও ইমদাদুল হক তালুকদারকে ধন্যবাদ। মঞ্চে উপভোগ করা ছাড়াও মেলায় বিলুপ্ত কিছু গ্রামীণ লোকজ ঐতিহ্য প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়ায় বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা যেমনটা সম্ভব হবে, তেমনি বাঙালির কাছে তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি ফিরে আসবে।'
জালাল খাঁ সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। তার জীবদ্দশায় গানগুলোকে বিভিন্ন 'তত্ত্ব' এ বিন্যস্ত করে চারখণ্ডের 'জালাল-গীতিকা' গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০৫ সালে আরও ৭২টি গান নিয়ে শিক্ষাবিদ যতীন সরকার 'জালাল গীতিকা সমগ্র' প্রকাশ করেন।
যতীন সরকার তার বক্তব্যে বলেন, 'বাউল একটি বিশিষ্ট লৌকিক ধর্ম ও সাধন প্রণালীর নাম। বাউলসহ সকল লৌকিক ধর্মেরই অন্তঃসার বিদ্রোহী চেতনা। জালালের অধিকাংশ গানেই বিদ্রোহী চেতনা প্রকাশ ঘটেছে।
ইউএনও ইমদাদুল হক বলেন, 'একুশে পদকপ্রাপ্ত সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ যে শুধু গান রচনা করেছে তা নয়, একই সঙ্গে বিশাল গুণমুগ্ধ ভক্ত অনুসারী সৃষ্টি করে গেছেন। মানুষকে বিভক্তির বেড়াজালে না জড়িয়ে কেবল মানুষ হিসেবে দেখার আর সাধনার আহ্বান জানিয়েছেন জালাল খাঁ। এতেই রয়েছে মঙ্গল।'
Comments