শহীদ সাবেরের ভাগ্য কারো জীবনে না আসুক

শহীদ সাবের (১৮ ডিসেম্বর ১৯৩০—৩১ মার্চ ১৯৭১)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল (প্রথম আলো থেকে)

আজিমপুর কলোনিতে থাকতেন। সালামতউল্লাহ নানার বড় ছেলে সাবের। পেয়ারুর বড় ভাই। পেয়ারু ভাইকে চিনি-জানি কিন্তু সাবের নামের তার এই ভাইকে চিনতাম না। নাম এ কে এম শহীদুল্লাহ, ডাক নাম সাবের। শহীদ সাবের নামে লেখক পরিচিতি।

তিনি ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় চার বছর জেল খেটেছেন। জেল থেকেই আইএ ও বিএ পাস করেছেন। সিএসপি এবং সিআইএস পরীক্ষায় পাস করেও জেলখাটা রাজনীতিক বলে সরকারি চাকরি পাননি। নিজ পছন্দের এক জমিদার কন্যার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও জেলফেরত কমিউনিস্ট বলে সেই জমিদার কন্যাকেও পায়নি। পরে সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। সরকারি চাকরি, প্রতিষ্ঠা, বিয়ে কোনোটি না হওয়ায় অজানা সংকটে প্রায় অস্বাভাবিক হয়ে যান।

সালামতউল্লাহ নানার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর দুই ছেলে সাবের ও পেয়ারু। প্রচণ্ড মেধাবী সাবের কেন এমন হয়ে গেলেন কেউ তা জানে না। সৎমায়ের সংসারে বেড়ে ওঠা সাবের ও পেয়ারুর। সৎমায়ের সংসারে থাকলে যা হয়; এদের দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। দুই ভাইয়ের প্রতি অন্যায় আচরণের জন্য এদের সৎমাকে আমার বাবা নাকি রাগে-ক্ষোভে শাসন করতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সাবের বইও লিখেছেন। বেরোনো দুটি বই নিজ হাতে লিখে উপহারও দিয়েছিলেন বাবাকে। বই দুটি এখনো বাসায় আছে স্মৃতিস্বরূপ।

বাসায় ফিরে বাবার সেলফ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বই দুটি উদ্ধার করি। 'কালো মেয়ের স্বপ্ন' এবং 'এক টুকরো মেঘ' দুটি বইয়ের ভেতরের পাতায় তার স্বহস্তে লেখা, 'সিরাজ মামাকে, স্নেহভাজন সাবের।' লোকটির প্রতি আমার সমস্ত ভালো না লাগা নিমিষে উধাও। মানুষটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বিশাল জায়গা মুহূর্তে তৈরি হয়ে যায়।

১৯৩০ সালের ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁওর সোনাপুকুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্ম এবং ঈদগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় নিজ মাকে ছেড়ে পিতার কাছে সৎমায়ের সংসারে কলকাতা চলে যান। কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হয়ে বরাবরই ক্লাসের সেকেন্ড বয় হিসেবে পরিচিতি পান। 'ছন্দ শিখা' নামক হাতে লেখা পত্রিকার মাধ্যমেই তার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। মুকুল ফৌজেও যুক্ত ছিলেন। আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদে স্কুলছাত্র শহীদ সাবেরের প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে ইত্তেহাদে তার লেখা গল্পও ছাপা হয়েছিল। ইত্তেহাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতা দেখতেন জহুরি সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবিব। আহসান হাবিব শহীদ সাবের সম্পর্কে বলেছিলেন, অমন সপ্রতিভ দ্বিতীয় কাউকে তিনি দেখেননি। বয়সের তুলনায় অসামান্য পরিপক্ব প্রতিভাধর শহীদ সাবের।

দেশভাগে সপরিবারে তারা পূর্ববাংলায় চলে আসেন। চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন সাবের। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে আইএ পড়ার সময়ে তখনকার একমাত্র অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ও কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যুক্ত হয়ে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রগতিশীল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রজুড়ে তখন কমিউনিস্টদের ওপর চলছে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সেই ধারাবাহিকতায় ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের ওপর ইচ্ছেমতো যখন-তখন হামলা চালায়।

১৯৫০ সালে ছাত্র ফেডারেশনের এক সমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা না দিয়ে নিরাপত্তা বন্দি শহীদ সাবেরকে চট্টগ্রাম কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পরে তাকে আতঙ্কের জেলখ্যাত রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে সেনাবাহিনী লেলিয়ে রাজশাহী জেলে হত্যা করা হয় সাতজন কমিউনিস্ট রাজবন্দিকে এবং এতে আহত হন শতাধিক রাজবন্দি। বন্দিদের আতঙ্কগ্রস্ত করা এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার জন্যই দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে কমিউনিস্ট বন্দিদের রাজশাহী কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। রাজশাহী জেলের সর্বকনিষ্ঠ রাজবন্দি ছিলেন শহীদ সাবের। রাজবন্দিরা তাকে খুব স্নেহ করতেন। এ তরুণের নানা আবদার-উপদ্রব হাসিমুখে সহ্য করতেন তারা, বিশেষ করে ঢাকার রেলশ্রমিক আন্দোলনের নেতা সুকুমার চক্রবর্তী।

১৯৫১ সালে রাজশাহী জেল থেকে আইএ পাস করেন সাবের। রাজশাহী জেল থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে বদলি হয়ে আসা বন্দি শহীদ সাবেরকে তার বাবা বন্ড দিয়ে মুক্তির উদ্যোগ নিলেও শহীদ সাবেরের অসম্মতি ও বিরোধিতার কারণে তা ভেস্তে যায়। সচিবালয়ে কর্মরত তার বাবা অনেক চেষ্টার পর যুক্তফ্রন্ট সরকারের কল্যাণে তাকে জেল থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। শর্ত ছিল ঢাকা থেকে কোথাও যাওয়া চলবে না। যেতে হলে গোয়েন্দা বিভাগের অনুমতি নিতে হবে। বিনা বিচারে চার বছর জেল খেটে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শাসনামলে ছাড়া পান তিনি। ছাড়া পেয়ে ১০/জে, আজিমপুর কলোনিতে বাবার সংসারে ফিরে আসেন। সংসারের আর্থিক সহযোগিতার জন্য আজিমপুরে ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। সাবের একই সঙ্গে জগন্নাথ কলেজের নৈশ শাখায় বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে বিএ পাস করেন।

চট্টগ্রাম জেলে বসেই বন্দিজীবনের কাহিনি নিয়ে লিখেছিলেন 'আরেক দুনিয়া থেকে' নামক রোজনামচা। লেখাটি গোপনে জেল থেকে পাচার হয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত নতুন সাহিত্যের চৈত্র ১৩৫৭ সংখ্যায় ছাপা হয়। লেখাটি নিয়ে চারদিকে সাড়া পড়েছিল। কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লিখে এ নতুন প্রতিভার আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। নিরাপত্তা বন্দি বলেই স্বনামে লেখা ছাপানোর অধিকার তার ছিল না। 'আরেক দুনিয়া থেকে' ছাপা হয়েছিল 'জামিল হোসেন' ছদ্মনামে। কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে সেই তার যাত্রা শুরু, কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১৯৫৪ থেকে '৫৮—মাত্র এ কটি বছরই মূলত তিনি লিখতে পেরেছিলেন। বিএ পাস করে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। সংবাদের সম্পাদকীয় তিনিই লিখতেন এবং দেখতেন সাহিত্য পাতাও।

সংবাদে চাকরিরত অবস্থায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে (সিএসএস) অন্তর্গত সিএসপি পরীক্ষায় বসেন; লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চোখের সমস্যার অজুহাতে নিশ্চিত সরকারি চাকরি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়। পরে তিনি ফেডারেল ইনফরমেশন সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে পুরো পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন জেলখাটা কমিউনিস্ট, তার সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্ট সন্তোষজনক ছিল না। এ কারণে তাকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি বিস্তারিত জানালে তিনি এ ব্যাপারে ওভার রুল করে, নিয়োগপত্র প্রদানের সরকারি নির্দেশের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সেই রাতেই সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। শহীদ সাবেরের পরিবার ও শ্রেণির আকাঙ্ক্ষা এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণতন্ত্র একই সঙ্গে ভেস্তে যায়।

ভালোবাসাহীন সামাজিক-পারিবারিক বিচ্ছিন্ন শহীদ সাবের ঘৃণায়-যন্ত্রণায় নিজের প্রতি নিজে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন কি? দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পাগলামি না করেও পাগলের খ্যাতি-দুর্নাম নিয়ে ১৯৬৭ থেকে '৭০ সাল পর্যন্ত কবিতা লিখতে পেরেছিলেন কীভাবে?

শহীদ সাবেরের লক্ষ্য-প্রত্যাশা-প্রাপ্তি ছিল সমন্বয়হীন, যা তাকে হতাশ করে তুলেছিল। ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমও ব্যর্থ হয়ে যায়। সেই জমিদার কন্যার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। হতাশার ধূম্রজাল তাকে চারদিক থেকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তার মানসিক বিপর্যয় শুরু হয়। ময়মনসিংহের মামাতো বোনের বাড়িতে নিভৃতে পুড়িয়ে ফেলেন প্রেমিকার নীল কাগজের চিঠিগুলো। চিঠি পোড়ানো প্রসঙ্গে মন্তব্য ছিল, 'বাজে জিনিস পুড়িয়ে ফেলাই ভালো।'

নিজের অবস্থানে টিকে থাকতে না পারার যন্ত্রণায় জীবনের প্রতি তীব্র অনীহা কিংবা ঘৃণায় নিজের মধ্যে গুটিয়ে যান শহীদ সাবের। তার সেই মানসিক বিপর্যয়কালে সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই উদ্যোগ নিয়ে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তার বন্ধু প্রয়াত সাংবাদিক ফাউজুল করীম এবং মন্টু খান তাকে সঙ্গে নিয়ে পাবনার হাসপাতালে রেখে আসেন। চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও চিকিৎসার ধারাবাহিকতার অভাবে তার আর সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব হয়নি। পরে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাওয়া, পেটিকোট, আন্ডারওয়্যার পরে রাস্তায় বের হয়ে যাওয়ার মতো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাও ঘটেছিল। নোংরা ও অপরিষ্কার থাকা তার মজ্জাগত হয়ে যায়। বেগম সুফিয়া কামাল এবং ওয়াহিদুল হক-সন্জীদা খাতুন তাকে পরিচ্ছন্ন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে নিজেদের বাড়িতে নিয়েও রাখতে পারেননি। ফাঁকি দিয়ে সেখান থেকেও তিনি পালিয়ে যান। তার জীবন হয়ে পড়ে অসংলগ্ন এবং প্রথাবিরোধী।

বংশালের সংবাদ অফিসই হয়ে উঠেছিল সাবেরের একমাত্র আশ্রয়স্থল। সারাদিন উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে রাতে ঘুমাতে যেতেন সংবাদ অফিসে। মেঝে, বারান্দা, হাতলবিহীন চেয়ার ছিল তার ঘুমের স্থান। সংবাদ অফিস থেকে তাকে প্রতিদিন দুই টাকা দেওয়া হতো। প্রেস ক্লাবে খাওয়া ছিল ফ্রি। ফ্রি খাওয়ার বেলায়ও ছিলেন অনিয়মিত। সিগারেট, একমাত্র সিগারেট খেতেই সবার কাছে হাত পাততেন নির্দ্বিধায়। জীবনের বোঝা বয়ে বয়ে উদ্‌ভ্রান্ত জীবনে অভ্যস্ত শহীদ সাবের মূলত বন্ধুদের সাহায্যেই বেঁচে ছিলেন। ছিল না বোধ। ছিল না স্বপ্নপূরণের সামান্য মানসিক শক্তি। কেউ খাওয়ালে খেতেন নয়তো না খেয়েই থাকতেন। অনাহার ছিল তার নিত্যসঙ্গী।

ভালোবাসাহীন সামাজিক-পারিবারিক বিচ্ছিন্ন শহীদ সাবের ঘৃণায়-যন্ত্রণায় নিজের প্রতি নিজে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন কি? দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পাগলামি না করেও পাগলের খ্যাতি-দুর্নাম নিয়ে ১৯৬৭ থেকে '৭০ সাল পর্যন্ত কবিতা লিখতে পেরেছিলেন কীভাবে? যদি পাগলই হবেন তবে তাকে নিয়ে পত্রিকায় কেউ কিছু লিখলে তার প্রতিবাদে বলতেন কীভাবে 'আমি কি পণ্য? আমার কথা লিখেছেন কেন?'। দৈনিক পাকিস্তান (দৈনিক বাংলা) পত্রিকার অফিসে গিয়ে কবি শামসুর রাহমানকে বলেছিলেন, 'আপনাকে কিন্তু এক বোতল মদের মতো লাগছে। বেশ তাজা। খুব ফেনা আছে তাই না? আমি ভেবেছিলাম ওয়ান শুড নট বি দ্য হ্যাসব্যান্ড অব রিস্কি হুইস্কি।'

পরিবার-পরিজন থেকেও মানুষটি পাননি যথাযথ ভালোবাসা ও সহমর্মিতা। তার সুচিকিৎসা হয়নি। ভালো হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা থাকলেও সুচিকিৎসা ও পরিচর্যার অভাবে তার আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। বাবা মৃত্যুপথযাত্রী, শোনামাত্র সাবেরের অনুজ পেয়ারু বাবার কাছে ছুটে গেলেন। যাওয়ামাত্র বাবার প্রশ্ন 'সাবের কোথায়? তাকে নিয়ে আসোনি কেন?' উত্তরে পেয়ারু বলেছিলেন, 'সাবের ভাইকে আনতে গেলে আমারই আসা হতো না। সে কখন কোথায় থাকে তার হদিস পাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব না।' বাবার অন্তিম কথা ছিল—'আমার জীবনটা ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ। যা চেয়েছি তা পাইনি। তোমাদের যা করতে চেয়েছি তাও পারলাম না।'

পরিবারের আকাঙ্ক্ষার প্রতি নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও উপায় ছিল না সাবেরের। পরিবারের প্রতি দায়িত্বসচেতন ছিলেন বলেই ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে শিক্ষকতা এবং সংবাদে চাকরি করে বেহিসেবি বাবাকে নিয়মিত অর্থ দিতেন। সৎমায়ের পাঁচ ছেলেমেয়ের সংসারের দায়িত্ব পালনে ছিলেন না উদাসীন।

অনুজ পেয়ারু ম্যাট্রিক পাস করেই চাকরিতে ঢুকে যান। চাকরিরত অবস্থায় আইকম ও বিএ পাস করেন। বাবার সংসারের অভাব দূর করতে দুই ভাই ছিলেন সদা তৎপর। খেলার বয়সে খেলাধুলা পর্যন্ত করতে পারেননি। সৎ-ভাইবোনদের অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাদের দুই ভাইয়ের কোলেপিঠে তারা বড় হয়েছে। অথচ এই সৎ-ভাইবোনেরা মিলে ১৯৭০ সালে বাবার জাল স্বাক্ষরে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরার পৈতৃক বাড়ি থেকে শহীদ সাবের ও তার অনুজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক (পার্সোনাল) সাইফুল্লাহ পেয়ারুকে চিরবঞ্চিত করেছে। পেয়ারু মামলা করলেও মামলার দীর্ঘসূত্রতায় আজ অবধি পৈতৃক ভিটার অধিকার ফিরে পাননি।

২৫ মার্চের গণহত্যা-পরবর্তী সান্ধ্য আইন শিথিল হওয়ামাত্র পুরানা পল্টন লেনের দাদার বাড়ির সবাই ঢাকায় আমাদের পুরো পরিবার আত্মরক্ষার্থে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কুশিয়ারবাগে আশ্রয় নিয়েছিল। সাবেরের অনুজ পেয়ারুও সঙ্গে ছিলেন। অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদের মায়ের কাছে জেনেছিলাম, সাবের নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দাদার বাড়িতে এসেছিলেন। তালাবন্ধ শূন্য বাড়িতে কাউকে না পেয়ে অগত্যা নিঃশব্দে ফিরে গেছেন আদি ঠিকানা বংশালের সংবাদ অফিসে। ১৯৭১-এর ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি হানাদাররা প্রগতিশীল ও জাতীয় চেতনার দৈনিক সংবাদ অফিস আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। সংবাদের স্থায়ী বাসিন্দা ঘুমন্ত শহীদ সাবের সেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। তার দেহের সৎকার তো দূরের কথা, শনাক্ত পর্যন্ত করা যায়নি। পুরো সংবাদ অফিসের সঙ্গে ছাই-ভস্ম হয়ে যান দৈহিকভাবে বেঁচে থাকা সাবের।

নির্লোভ-নির্মোহ সমষ্টিগত জগৎটিকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েই জীবন ও সৃষ্টির জগৎ থেকে স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেছেন। নিজে হেরে সবাইকে হারিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাই আজকের এই লেখায় প্রত্যাশা করছি- শহীদ সাবেরের ভাগ্য যেন আর কোন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনে না আসে!

রাষ্ট্রীয় খড়গে জেলফেরত শহীদ সাবের রাজনীতিতে যুক্ত থাকতে পারেননি। সাংবাদিকতা পেশাও তাকে দিতে পারেনি আর্থিক নিশ্চয়তা। পরিবার ও শ্রেণির চাপে এবং ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমকে সফল করতে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছুটতে হয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠার পিছু। শাসক সহযোগী সরকারি আমলা হওয়ার জন্য নিজের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে সিএসপি এবং সিআইএস পরীক্ষা দিতে হয়েছে। নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ধরনা পর্যন্ত দিতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের মতাদর্শিক চিন্তা-চেতনার আত্মাহুতির মানসিক যন্ত্রণা-কষ্টে শহীদ সাবের দ্রোহী হয়ে বদলে গিয়েছিলেন। করেছিলেন ভিন্নমাত্রার নীরব প্রতিবাদ।

মতাদর্শিক অঙ্গীকার এবং নিজস্ব সত্তার বিকাশের বিপরীতে পিতা-পরিবার-শ্রেণি হতে ব্যক্তিগত প্রেম তাকে ঠেলে দিয়েছিল সনাতনী প্রতিষ্ঠার পেছনে, যা তার পক্ষে ছিল অসহনীয়। ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলতে গিয়ে মতাদর্শ ও বিবেক দংশনে বৈরী সমাজব্যবস্থার চাপে শহীদ সাবের অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান। শ্রেণির চাপে ক্ষত-বিক্ষত শহীদ সাবের নীতি ও মূল্যবোধের এ বিচ্যুতি সহ্য করতে পারেননি। তাই ভেঙেছেন, কিন্তু মচকে যাননি। আজকের ন্যায় সাংবাদিকতা তখন পেশা হিসেবে নিশ্চিত কিছু ছিল না। অনিয়মিত বেতন প্রাপ্তির বিড়ম্বনায় বাবা-মা-ভাইবোনদের ঢাকায় বাসা ভাড়া করে এনেও সংসারের ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়নি। সে জন্য তার বাবা আত্মীয়-পরিজনদের কাছে উপহাস করে বলতেন—'সাবের আমাদের অনাহারে না খাইয়ে মারার জন্য ঢাকায় এনেছে।' আর্থিক অনিশ্চয়তায় পুরো পরিবারকে চট্টগ্রাম ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

সাবের নিজের স্বাধীন স্বকীয়তায় চলতে পারেননি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তাকে অন্য পথে ঠেলে দিয়েছিল। যে পথের বিরুদ্ধে ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ। শ্রেণি উত্তরণের মোহ কিংবা নেশা তার ছিল না। থাকার কথাও নয়। চাপিয়ে দেওয়া নানা চাপে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় শহীদ সাবেরকে পাগলের খ্যাতি নিয়ে বাঁচতে হয়েছে এবং সবার অলক্ষ্যে পুড়ে মরতে হয়েছে। তার নির্লোভ-নির্মোহ সমষ্টিগত জগৎটিকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েই জীবন ও সৃষ্টির জগৎ থেকে স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেছেন। নিজে হেরে সবাইকে হারিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাই আজকের এই লেখায় প্রত্যাশা করছি- শহীদ সাবেরের ভাগ্য যেন আর কোন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনে না আসে!

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

3h ago