অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

আমাদের সাহিত্য দলবাজদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে

সমকালের অন্যতম কবি, গল্পকার ও গীতিকার জাহিদুল হক। বাংলা কবিতায় যুক্ত করেছিলেন নতুন মাত্রা। কবিতা ছাড়াও প্রবন্ধ ও গল্পেও তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। গানের ভুবনে 'আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়'সহ অজস্র কালজয়ী গানের গীতিকার হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ভারতের আসামে ১১ আগস্ট ১৯৪৯ সালে। পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামে। তিনি বাংলা একাডেমির একজন ফেলাে ও রেডিও ডয়েচে-ভেলের সিনিয়র এডিটর ও ব্রডকাস্টার হিসেবে কাজ করেছেন। দৈনিক সংবাদের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ বেতারে তিনি উপমহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৫ জানুয়ারি  আমাদের ছেড়ে যান তিনি।

জাহিদুল হকের কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প গান মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২১টি। তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হয় ১৯৮২ সালে 'পকেট ভর্তি মেঘ' শিরোনামে। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, পকেট ভর্তি মেঘ, তোমার হোমার, নীল দূতাবাস ও এ উৎসবে আমি একা। তার সঙ্গে ২০২২ ও ২৩ সালের একাধিক সময়ে কথায় উঠে আসে অজানা অনেক কথা। তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু অংশ প্রকাশ করা হলো।

যে কোনো দেশের সাহিত্যে কঠিন হিসেবে ধরা হয় কবিতার শাখাকে, এই পথে কিভাবে এলেন?

জাহিদুল হক : আসিনি এই পথে, জন্মেছি। কবিতায় আসা যায় না, কবিও হওয়া যায়না। কবিরা জন্মায়। তবে জন্মাবার পরে কঠিন সাধনার মাধ্যমে সারা পৃথিবী চষে তার শব্দগুচ্ছটিকে ধরে আনতে জানতে হয় কবিকে। কবিতা লেখা আর আপাতদৃষ্টিতে দেখতে কবিতার মতো কিছু লেখা এক নয়। ভাষাশিল্পের তো বটেই,আমার কাছে মনে হয় দুনিয়ার সব শিল্পের রাণী হলো কবিতা!

ব্যক্তিগত জীবন ও কবির জীবন আলাদা করে বলার মতো কিছু?

জাহিদুল হক: জীবন আর কবিতা অবশ্য আলাদা। তবে কবিতা বস্তুতপক্ষে কবির জীবনও আলাদা। আমার কবিতাও তাই। আমি কবিতায় যা লিখি তা আমাকেই লিখি এক জীবন। আমি কবিতায় আমার সঙ্গে কথা বলি, বলেছি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বেতারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর ৭ মার্চের সময় বাংলাদেশ বেতারে কাজ করতেন আপনি। সে সময়টা নিয়ে কিছু বলুন-

জাহিদুল হক: আমি সে সময় শাহবাগ কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলাম। সহকর্মীদের নিয়ে পরিকল্পনা করলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার করবো। আবেগ অনুভূতি নিয়ে প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু সে পরিকল্পনা হিসেবে কাজ হয়নি, উপরে থেকে বাঁধা এলো। করাচী থেকে জানালো বঙ্গবন্ধুর আজকের ভাষণ প্রচার করা যাবে না। তাদের মধ্যে  ভয় ছিল, বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা করে দেন।

কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে জাহিদুল হক ও ফরিদা মজিদ। ছবি কবির ফেসবুক থেকে।

আমি মেনে নিতে পারিনি বিষয়টি। এক সময় রাজনীতি করেছি, সেটা মনে আছে। ফেনী কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম। পরে রাজনীতি থেকে সরে এলেও দেশের জন্য যে কোনোভাবে কাজ করব সেটা মাথায় ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যে কোনভাবে হক প্রচার করতেই হবে। না হয়  ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দেবো, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আর আশফাকুর রহমান খান। তিনি আমার সিনিয়র, বন্ধুর মত। তাকে বললাম, চলো রেডিও বন্ধ করে দেই। সবাই তখনই মাস্টার কন্ট্রোল রুমে (এমসিআর) গেলাম সন্ধ্যায়। হাতে হাত রেখে স্টেশন সুইচ অফ করে দিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুর কথা মনে ছিল। তিনি বলেছিলেন, 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি...'। সেই প্রেরণায় বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম আমরা।

রেডিওতে থাকতে লেখা হয় 'আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়'। গানের সে কে?

জাহিদুল হক : হ্যাঁ, ১৯৭১ সালে আমি রেডিওতে লেখা। 'আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়' গানটি রেডিওর জন্য লেখা হয়। পরে ১৯৭৩ সালে সিনেমার গানের জন্যে পরিমার্জিত রূপ। গানের ভেতরের চরিত্রটি কে? জানিনা। হবে হয়তো 'আমি', 'আমার আমি' সেই সঙ্গে আমার ভালোবাসার মানুষটির 'আমার আমি'-ও! 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে ও আর কোনো স্মৃতিটা রয়েছে?

জাহিদুল হক: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন ফেনীর প্রখ্যাত আওয়ামীলীগ নেতা খাজা আহমেদ। আমি ছাত্র ইউনিয়নের লোক সত্ত্বেও তার দল আওয়ামীলীগের যে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। তিনিসহ একবার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। দ্বিতীয়বার ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় ফেনীতে জনসভায় তার ভাষণের আগে। ফেনী সার্কিট হাউসে আমিসহ কয়েকজন ছাত্রনেতার সঙ্গে মত বিনিময় করেন। আরেকবার একবার গণভবনে খাজু মিয়াসহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়।

কবি জাহিদুল হকের ৭২ তম জন্মদিন পালন হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। মঞ্চে কবি কামাল চৌধুরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মাহবুব হাসান ও জাকির আবু জাফর। ছবি: ইমরান মাহফুজ

বেতারে চাকরির সুবাদে অবশ্য বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আমার আন্তরিক দেখা এবং ডিউটি রুম থেকে টেলিফোনে কথা হয়। একবার ফোন করে জানতে চেয়েছিলে যে অধিবেশনের শেষে আমরা ক্লোজিং এনাউন্সমেন্টটা কীভাবে দিই! আমি আমার পরিচয় দিই। হেসে তিনি বলেছিলেন, 'ও, জাহিদ নাকি, তুই কেমন আছস রে।' তিনি জয় বাংলার সঙ্গে খোদা হাফেজ যুক্ত করতে বলেছিলেন এবং 'মুকুল'কে, অর্থাৎ ডিজিকে ফোন করতে বলার জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কুমিল্লার কাজী জহিরুল কাইউম। নানানভাবে সাহায্য করতেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। তার সূত্রে বঙ্গবন্ধু কি চৌদ্দগ্রাম এসেছিলো কখনো, কোথায় সেটা মনে পড়ে?

জাহিদুল হক: চৌদ্দগ্রামে চট্টগ্রাম যাওয়া-আসার পথে সভা-পথসভা করে থাকবেন অবশ্য। আমার এলাকা গুনবতীতেও এসেছিলেন। ফাতেমা জিন্নাহ আর মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে ট্রেনের এক কামরায় নির্বাচনী প্রচারে গুণবতী হয়ে চট্টগ্রাম ভ্রমণ করেছেন। আমি তখন ফেনী কলেজের ছাত্র, ফেনী জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ফেনী ইষ্টিশন থেকে লাকসাম অব্দি উত্তেজিত আমিও গিয়েছিলাম ওই ট্রেনে। কী অদ্ভুত ছিলো সেই স্মৃতির দিনগুলো!

বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নিয়মিত টিভি অনুষ্ঠান করেন আপনি। বাংলা সাহিত্যে আমরা কতটা এগিয়েছি বলে মনে করেন

জাহিদুল হক : বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কথা বলবে না। আমাদের লেখাপড়া একেবারেই নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের সাহিত্য একদল অশিক্ষিত, গ্রাম্য এবং নিম্ন শ্রেণীর দলবাজদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। আমাদের সাহিত্য এখন তলানিতে! কেউ বলে না সে কথা!

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

15m ago