পাঠক খরায় যেভাবে পাল্টানো যায় পাঠাগার চিত্র
সময় বদলেছে, বদলেছে মানুষের চলন ও বলন। বদলেছে পাঠকের পাঠ অভ্যাস। সে প্রসঙ্গে ৩ দশকের পাঠাগারের অভিজ্ঞতা জানাতে লেখাটি। আমি যুক্ত আছি রাজধানী খিলগাঁও শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগারে। এর বয়স ৫০ বছরের অধিক। কতশত শিক্ষার্থী, পাঠক এই পাঠাগারে এসেছে, উপকৃত হয়েছেন তার কোন হিসাব নেই।
একদিন দেখলাম- হঠাৎ করে প্রায় শূন্য হয়ে গেলো পাঠাগার, পাঠক নেই। অথচ কিছুদিন আগেও রীতিমতো বসার জায়গা নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিলো। একসাথে ৮০ জন পাঠক বসে বই পড়তে পারে, বইয়ের সংখ্যা ১৪০০০ এরও অধিক। পাঠাগারের দরোজা খোলার আগেই বসার জায়গার জন্য অপেক্ষা। এমনকি গ্রন্থাগারিক যদি কোনো কারণে একটু দেরি করেছে ঠিক তখনই অভিযোগ। সেখানে একদিনের ব্যবধানে বিপরীত চিত্র ! গ্রন্থাগারিক অবসন্ন। পাঠক শূন্য কতক্ষণ বসে থাকা যায়। আমি নিজেও বিব্রত, পাঠাগার এতো বই, আমাদের ভুল ছিল কোথায়? এমন অবস্থা আমাদের এইখানে, না সারাদেশে?
আপাতত ভাবছি আমাদের নিয়ে! সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় পাঠক কীভাবে বাড়ানো যায়। সময়টা ২০১৯। শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগার পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত হলো পাঠাগারে নোট, গাইড পড়া যাবে না এবং প্রতি শনিবার শুধুমাত্র শিশু-কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। অনেকটা একক আগ্রহে এই সিদ্ধান্ত। কারণ- যারা পাঠাগারে এসে পড়াশোনা করছে এরাতো আদৌ পাঠক নয়। পাঠাগারের কোন বইয়ের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই। এমনকি পাঠচক্র, আলোচনা, পাঠাগারের অনুষ্ঠান কোনো কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। পাঠাগার খোলা থেকে বন্ধ করার এই সময়টুকু মূলত চাকরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি। চাকরি প্রাপ্তির পর অথবা এই নির্দিষ্ট সময়ের শেষে এই শ্রেণী কখনোই পাঠক হয়ে আসেনি। তার মানে বর্তমানে যা চলছে এটা বাস্তবতা নয়। কিন্তু পাঠাগারতো হয়েছে সৃজন বিকাশে, বই পড়ায় উৎসাহিত করার জন্য।
খ
ছোট বড় অনেক পাঠাগার সারাদেশে। এতো বই এতো বিনিয়োগ পাঠক নেই! তবু সবাই এক ধরনের আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে আছি। এমন করে চলতে পারে না। নতুন পাঠক না তৈরি হলে সমাজ আগাবে না। সে দহনে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করতে হলো। এর মধ্যে করোনা এসে হানা দিলো। চারদিকে স্থবিরতা, পাঠাগারও বন্ধ। ২০২০ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে প্রস্তাব এলো বঙ্গবন্ধু শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই নিয়ে পাঠ কার্যক্রমের।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর পাঠাগার অন্তপ্রাণ একজন সংগঠক। এমনিতেই স্থবির দেশের পাঠাগারগুলো, তার উপর করোনার ভয়াবহতায়। উদ্যোগ নিলেন নিয়মিত পাঠ কার্যক্রমের। ধুলো ময়লা ঝেড়ে খুললো পাঠাগারের দরোজা। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতে থাকলো পাঠাগারে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র নিজের গণ্ডী ছেড়ে পাঠাগারে এসে উপস্থিত হলো।
এই কার্যক্রমে অংশ নেওয়া স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু হলো শনিবারের পাঠচক্র। ৪-৫ জন নিয়ে চলতে থাকলো পাঠ কার্যক্রম। লক্ষ্য করে দেখলাম এরা খুব আগ্রহী পড়া বইয়ের গল্পটি শোনাতে। এরই মাঝে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ঢাকা মহানগরীর পাঠাগারগুলোকে নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলো। পাঠাগারের পাঠকেরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে। সবাই মিলে পরিকল্পনা করলো- আর্নেস্ট হেমিংওয়ে Old Man and The Sea গল্পটি সবাই মিলে শোনাবে। মাত্র ৫ মিনিট বরাদ্দ, পাঠচক্রের একজন সদস্য গল্পটি লিখে দিলো ছোট করে। অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন অবশ্য উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। আমার যুক্তি ছিলো পাঠাগারের পাঠক বই নিয়েই কথা বলবে। এরাই আসল শক্তি আমাদের।
এমনি করে নিয়মিত চলে পাঠচক্র। এখন পর্যন্ত ৭৪ টি পাঠচক্র হয়েছে। অভিভাবকেরা এখন পাঠাগারে তাদের সন্তানদের নিয়ে আসে। সংখ্যায় খুব বড় না হলেও একটি শক্তিশালী পাঠক দল গড়ে উঠেছে যাদের উপস্থিতিতে আবার আলোকিত হয়ে উঠেছে পাঠাগার। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের গ্রন্থপাঠ উদ্যোগটি প্রশংসনীয় তবে চলমান এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত এবং স্থায়ী পাঠাগারগুলোর সম্পৃক্ততা এখনো পরিলক্ষিত হয়নি যা খুব জরুরি ছিলো। তাদের যথাযথ আন্তরিকতা পেলে সারাদেশের পাঠাগারগুলো আরও প্রাণবন্ত হয়ে সমাজের কাজে লাগতো।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র যদি জেলা অথবা অন্তত বিভাগীয় পর্যায়ে একটি করে মডেল পাঠাগার করে, সেটা আরও ফলপ্রসূ হবে। কারণ স্থায়ী এবং প্রথম সারির পাঠাগারগুলোর অবস্থাই নাজুক। এগুলোকে দ্রুত গতিশীল করা জরুরি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বর্তমানে যে সমস্ত পাঠকার্যক্রম করছে তার মধ্যে অনেক পাঠাগারই সংগঠকদের ব্যস্ততা এবং আর্থিক সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই জরুরি একটা মাঠ পর্যায়ের গবেষণা ও বাস্তবায়নের।
অবশ্য মনে রাখতে হবে, সম্পদ মূল্যে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠা পাঠাগারগুলোতে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। একটি দেশে বেসরকারি উদ্যোগে এতো পাঠাগার আর কোন দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। কিছুদিন আগে ব্রিটিশ এক শিক্ষক এসেছিলেন শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগারে। তিনি ধারণা করেছিলেন এটি সরকারি পাঠাগার- তা নয় জেনে অবাক হয়েছিলেন।
গ
আমার ৩ দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাঠাগারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাব । ঢাকার বাইরে ব্যক্তিগতভাবে সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য পরিষদ এবং নারায়ণগঞ্জের সুধীজন পাঠাগার ঘুরে আসার পর মনে হলো তাদের কার্যক্রমের বেশ বৈচিত্র্য আছে। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য পরিষদের সাহিত্যসভা এবং সুধীজন স্কুল ভিত্তিক কার্যক্রম করে থাকে। আবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন অঞ্চলের পাঠাগারগুলোর এই কার্যক্রমগুলো এবং নিজেদের সংগৃহীত বই নিয়ে পারস্পরিক তথ্য বিনিময় পাঠাগারগুলোর বই পাঠ আন্দোলনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারতো। বিশেষত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গাড়ি যখ বিভিন্ন জায়গায়- পাঠক শূন্য অবস্থায় সময় কাটায় তখন খারাপ লাগে। মনে হয় পারস্পরিক যোগাযোগটি খুবই প্রয়োজন।
কেবল সংগঠন সংগঠন করে হাহাকার নয়। প্রাথমিকভাবে নিজেদের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আশার কথা সে কাজটি আমরা শুরু করতে পেরেছি। ঢাকা মহানগরীর লালবাগের গ্রন্থবিতান, গেণ্ডারিয়ার সীমান্ত লাইব্রেরি, যাত্রাবাড়ীর দনিয়া পাঠাগারসহ বেশ কয়েকটি পাঠাগারের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। কেবল বই পাঠ নয়, পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির নানান কর্মকাণ্ড পাঠাগারকে প্রাণ চঞ্চল রাখছে এবং রাখবে। সেভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
পাঠক নেই, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বই পড়ে না এটি খুব প্রচলিত কথা। এর পেছনে কারনটি কি? পাঠাগার পরিচালনা করতে গিয়ে আমার যে উপলব্ধি সেটা হলো এর প্রধান বাঁধা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, এটা জ্ঞানভিত্তিক নয় প্রতিযোগিতামূলক। অন্যদিকে অভিভাবকদের ধারণা সারাদিন বই পড়ে আবারও বই? সবার প্রথমেই তারা তাদের সন্তানদের পাঠ্য বই এর বাইরে অন্য বই পড়ায় নিরুৎসাহিত করেন। তাদের সৃজনশীল ভাবনার জায়গাটি রুদ্ধ করে দিচ্ছি যার ফলে এরা উচ্চতর শিক্ষা অথবা পেশাগত জীবনে খুব একটা ভালো করছেনা। অথচ আমরা যাকে আউট বই বলি সেই বই পড়া মানুষগুলো এগিয়ে যায় সফলতার দিকে।
বিশ্বের সমস্ত জাতির সভ্যতা বিকাশের সাথে পাঠাগার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। দুঃখজনক হলো আমাদের এখানে পাঠাগার বিষয়টি সেভাবে গড়ে উঠেনি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি অংশ হিসেবে নয় প্রয়োজন পাঠাগারের জন্য স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ের। কারণ পাঠাগার বিষয়টি অনেক বিশাল, সংস্কৃতির বিকাশ পাঠাগারের মাধ্যমেই সম্ভব বলে বিশ্বাস করি।
সম্পাদক, শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগার
Comments