পর্যালোচনা

কালের গর্ভে কি হারিয়ে যাবে গোয়ালন্দ ঘাট

চলার বাঁকে বাঁকে সময়ের মতো নদী গল্প আঁকে। মানুষ সে গল্প কখনো জমা রাখে ঘাটের কাছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের  সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু ঘাটের গল্প জড়িয়ে আছে। তেমনি এক সাক্ষী গোয়ালন্দ ঘাট। কেবল নৌকা ফেরী না- কত ইতিহাস স্মৃতির পাতায় আঁটকে রেখেছে তার ইয়ত্তা নেই!  

সাহিত্যের পাঠকমাত্র পড়েছেন 'পদ্মা নদীর মাঝি'। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ এক উপন্যাস— এ নিয়ে  প্রশ্ন তোলার অবকাশ কম। পদ্মা সেতু দেশের উল্লেখযোগ্য নির্মাণ—এ নিয়েও বিতর্ক নাই। কিন্তু পদ্মার ইলিশ স্বাদে সেরা—এ ব্রান্ডিংটা কে বা কারা করেছে, কেমন করে পদ্মার ইলিশ অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে উঠল তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

আদি রূপকথার গল্প নয়, অর্ধ শতাব্দী আগেও রূপালী ইলিশের বিচরণ ছিল প্রায় সকল বড় নদ-নদীতে। অঞ্চলভেদে ইলিশের স্বাদ হয় স্বতন্ত্র। ব্যক্তিভেদে স্বাদ ও রুচির ভিন্নতা চিরন্তন। পদ্মার ইলিশ সার্বজনীন মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা বিস্মিত করে। পদ্মার ইলিশ সেরা-- ব্রান্ডিংয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের বিশাল ভূমিকা। হোসাইন মোহাম্মদ জাকির 'ঘাটের কথা- গোয়ালন্দ' পাঠে এই ধারণা আরও পোক্ত হলো।

বর্তমানে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলায় অবস্থিত গোয়ালন্দ ঘাট। পদ্মা নদী গোয়ালন্দে এসে যমুনা নদীর সঙ্গে মিলে ফরিদপুর-হাজীগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। পদ্মার আগ্রাসনে গোয়ালন্দ ঘাট বিভিন্ন সময়ে স্থানান্তর হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। তবু মানুষের পদচারণে মুখরিত থাকত এই নৌবন্দর।

ইতিহাস বলে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে অনেক ঐতিহাসিক ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে চিহ্নিত করেন। এই সংগ্রাম ব্যর্থ হয়েছিল। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ঘুরে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ শাসকরা নিজ স্বার্থেই এমন সব উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছিলেন যা স্থানীয়দের জন্য শাপে বর হয়েছিল। প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের পর গোয়ালন্দ ঘাট ধরে স্টিমার চলাচল শুরু হলে কলকাতা হতে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত যাতায়াত সহজ হয়। ওই সময়ের স্টিমার এখনকার মতো দ্রুতগামী ছিল না। দীর্ঘ যাত্রায় যাত্রীদের স্টিমারের খাবারের ওপর নির্ভর করতে হতো।

স্টিমার সার্ভিসের সূচনাকাল হতে সচ্ছল যাত্রীদের কাছে গোয়ালন্দের ইলিশ কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। ইলিশের স্বাদ আর রন্ধনশৈলীর কারিশমা মিলে মিশে যাত্রীদের মোহগ্রস্ত করেছিল বলা যায়। আজকাল মাওয়া ঘাটে গিয়ে ইলিশ খাওয়া যেমন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, তখন গোয়ালন্দে ইলিশের ঝোল মাখিয়ে ভাত খাওয়াও ছিল অনেকটা তেমন। যাত্রীদের পছন্দের আরেকপদ ছিল 'ইস্টিমার চিকেন কারি', যা পরবর্তীতে 'গোয়ালন্দ চিকেন কারি' নামে পরিচিতি লাভ করে। একবার যে এই কারির স্বাদ পেয়েছে সে-ই এই কারির প্রেমে পড়েছে। 'গোয়ালন্দ চিকেন কারি'র একনিষ্ঠ প্রেমিকের তালিকায় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সৈয়দ মুজতবা আলী পর্যন্ত অনেকেই ছিলেন।

ফেরিতে গোয়ালন্দ অতিক্রমের সময় আজও ভাবুকতা ভর করে। কল্পনার চোখে ভাসে সেবাস্টিয়ান গঞ্জালিস- এক পর্তুগিজ জলদস্যু। বহু শত বছর আগে প্রমত্তা পদ্মার এই এলাকায় দস্যুতা করে বেড়াত। গঞ্জালিস নামটা পরিবর্তিত হতে হতে কালক্রমে জায়গার নাম হলো গোয়ালন্দ। গঞ্জালিসকে দ্বিধায় জর্জরিত করে উপস্থিত হয় পর্তুগিজ জাত শব্দ 'গোয়ালিশ ল্যান্ড'। 'গোয়ালিশ ল্যান্ড' হতে  গোয়ালন্দের নামকরণে বাঁধ সাধেন সম্রাট জাহাঙ্গীর, তিনি গোয়ালা অধ্যুষিত এ অঞ্চলকে শুভাশিস জানিয়ে বলেছিলেন 'জিতে রাহ গোয়াল-ই-আনন্দ।' নামকরণ যেভাবেই হোক পদ্মা অধ্যুষিত এ অঞ্চল যে গো সম্পদ আর মাছে সমৃদ্ধ ছিল তা নিশ্চিত। 

গোয়ালা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত গোপালা থেকে। গোপালা হলো গরুপালনকারী সম্প্রদায়। বিভিন্ন কারণে গোয়ালারা ব্রিটিশ আমল থেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। গোয়ালা সম্প্রদায়ের বিশাল অংশ আসামের চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয়। কিন্তু মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম অর্ধশতক পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য হারে গোয়ালাদের পেশা পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়েনি। আজ যে অঞ্চলের নাম গোয়ালন্দ, একসময় সেখানে গোয়ালা সম্প্রদায়ের বাসছিল। স্থানীয়দের বিশ্বাস গোয়ালা হতে গোয়ালন্দ নামটি এসেছে।

আমি ইতিহাসবেত্তা নই, তবু সংশয় জাগে গোয়ালা অধ্যুষিত এ অঞ্চলের নামকরণে গোয়ালার সাথে পার্সি শব্দ 'অন্দর' (অভ্যন্তর, মধ্যস্থল, আবাস) যোগ হয়ে 'গোয়াল-অন্দর' এবং 'গোয়ালন্দর' হতে কালক্রমে গোয়ালন্দ নামটির উৎপত্তি হওয়া কি অস্বাভাবিক! মোগল শাসনের বহু আগে থেকেই বাংলা ভাষার অন্দর মহলে পার্সি শব্দের বসবাস। পাঠক হিসেবে কল্পনার ঘোড়া ছোটানোর স্বাধীনতা আমার রয়েছে। তবে 'ঘাটের কথা-গোয়ালন্দ'র লেখক হোসাইন মোহাম্মদ জাকি কল্পনার আশ্রয় গ্রহণে বিন্দুমাত্র রাজী নন। তিনি গবেষণালব্ধ তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধ। তিনি গল্পের ছলে ইতিহাস বলেছেন, ইতিহাসের ছলে গল্প বলেন নাই।

ইতিহাস বিমুখ হিসেবে আমাদের বদনাম রয়েছে। আমরা স্বভাবে বিস্মৃতিপ্রবণ। দুইয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে ইতিহাসের নামে কল্পকাহিনী প্রতিষ্ঠার অসুখ। পদ্মা সেতুর পর গোয়ালন্দ ঘাটের ব্যস্ততা কমেছে। কমেছে গুরুত্ব আর প্রতাপ। ব্যস্ত গোয়ালন্দ অনেকটা বিশ্রামে। দ্বিতীয় পদ্মা সেতু  হলে গোয়ালন্দ ঘাটের প্রভাব আরও কমবে। তাহলে কী কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে গোয়ালন্দ!

গোয়ালন্দ—নদী বন্দর থেকে স্টিমার ঘাট, স্টিমার ঘাটের সাথে রেল স্টেশন, পূর্ব বঙ্গের বাণিজ্যিক প্রাণস্পন্দন আর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণের উদাহরণ। গোয়ালন্দ এমন এক নদী বন্দর যার ঐতিহাসিক অবদান অপরিসীম। কেবলমাত্র পরিবহন সংযোগ কেন্দ্র হিসেবে নয়, গোয়ালন্দ সারাদেশের মানুষ এবং সংস্কৃতির সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। পদ্মার ইলিশ আর সোনালী আঁশ পাটের দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়া আর স্বচ্ছল জীবনের আশায় শ্রমিক হিসেবে আসামের চা বাগানে যাওয়া এবং নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসার কান্নার মত বহুমাত্রিক ইতিহাসে গোয়ালন্দ ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। গোয়ালন্দ রাজবাড়ী জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসের সাধারণ অংশ নয়, গোয়ালন্দ ভারতের ইতিহাসের অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

ইতিহাস খুব সরল বস্তু নয়। ইতিহাস লেখক একই সাথে গবেষক এবং গল্প কথক। গভীর অনুসন্ধান, সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ, হারিয়ে যাওয়া সূত্রের মিমাংসাসহ অজানা তথ্যের বিন্যাসে নির্মোহতার কাছে দায়বদ্ধ থেকে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেন। জাতীয় দৈনিক সমূহের নিয়মিত পাঠকদের কাছে গবেষক ও সুলেখক হোসাইন মোহাম্মদ জাকি নামটি অপরিচিত নয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেন্দ্রিক গবেষণায় নিরলস লেখক সরল গদ্যে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যে পাঠকদের চমকে দিতে ভালবাসেন। তার গ্রন্থ পাঠ করলে মন বলে ওঠে 'কত- অজানারে...।'

তার রচিত 'ঘাটের কথা- গোয়ালন্দ' নি:সন্দেহে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করার গ্রন্থ। এতে তিনি গবেষণা লব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে গোয়ালন্দ ঘাটের ইতিহাস মলাট বন্দী করেছেন। লেখকের বর্ণনার ঢং পদ্মা নদীর ঢেউয়ের মতোই বেগবান ও সরল। যোগ হয়েছে প্রয়োজনীয় ছবি, মানচিত্র এবং দুর্লভ বিজ্ঞাপন। বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'ঐতিহ্য'। আগ্রহী পাঠক ঘাটে না গেলেও বইটি কাছে নিয়ে দেখতে পারেন।

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

5h ago