বন্ধু কবি তারিক সুজাত

ছবি: সংগৃহীত

আমার প্রিয় কবি বন্ধু। সলজ হাসিমাখা মুখ। এমন কর্ম তৎপর, নানা স্বপ্নে বিভোর। দুর্দান্ত উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী। পেশাদার এবং সৃজনশীল দুক্ষেত্রেই তিনি অভিনব। বয়স মাত্র পঞ্চাশ পেরিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে সে দায়িত্বশীল অনেক কাজ করেছে। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে এমন কেউ নেই যারা তাকে চেনে না এবং ভালোবাসে না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনাও তাকে চেনেন। তার কাজকর্ম পছন্দ করেন। তিনি আমাদের তারিক সুজাত। সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বড় বড় কাজের সঙ্গে তারিক গভীর ভাবে জড়িত থাকে। এসবের আড়ালে চাপা পড়ে যায় তার কবি খ্যাতি। তারিক তার সমকালে একজন বড় কবি। তার কবিতা মনোযোগের দাবী রাখে। খুব সহজ ও আদুরে তার কবিতা। ইদানীং তারিকের কবিতা চিরন্তন ধারার কবিতার পথে বাঁক নিয়েছে। ছোট ছোট গীতল কবিতা।

রবীন্দ্রনাথ, ওমর খৈয়াম, মীর তকি মীরের কবিতা ভেঙেচুরে, নতুন ব্যঞ্জনায় তিনি তারিকীয় কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতার অনুভূতির মধ্যে মানুষ প্রেমের ক্ল্যাসিক ধারাটি মূর্ত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথকে টুকরো টুকরো বিনির্মাণ করে তারিক দুই তিনটে কবিতার বই প্রকাশ করেছে। একটা দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। রফিকুন নবী প্রতিটা কবিতার সঙ্গে পেইন্টিং করেছেন। বাংলা ভাষায় এমন সুমুদ্রিত কবিতার বই আর কি আছে! ভাগ্যবান তারিক। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নাম যশের জন্য সে অকারণে লাফ-ঝাঁপ করে না। তারিকের বিনয় তারিককে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

তারিক সুজাতের বাবা স্বনামে সুখ্যাত তোফাজ্জল হোসেন। ছোটবেলায় মুকুল ফৌজ করতেন শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে। চাকরি জীবনে সরকারি তথ্য সার্ভিসে উচ্চপদে কাজ করেছেন। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের তিনি একজন সৈনিক। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলনে তোফাজ্জল হোসেনের কবিতা ছাপা হয়। এটাও এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

সেই ঐহিতাসিক ব্যক্তিত্ব তোফাজ্জল হোসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র তারিক সুজাত। তারিক তরুণ কবিদের প্রতিনিধি। দীর্ঘ তিন দশক ধরে তারিক কবিতা লিখছে। জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রথম দিন থেকে সে জড়িত। এখন তারিক জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। বিগত বছর গুলোতে তারিকের একক কৃতিত্বেই কবিতা উৎসব আয়োজিত হয়। তারিক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 'কৃত্তিবাস' পত্রিকার নামে 'কৃত্তিবাস' পুরষ্কার পেয়েছে। ফৌজ পাবলিশিং থেকে বাংলা ভাষার সেরা কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় তারিক সুজাতের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তারিক সুজাত অবশ্য দুই বাংলাতেই কবি হিসাবে সুখ্যাত।

তারিকের বহুমাত্রিক কর্ম সাফল্য সম্পর্কে একটু ধারণা দেয়া যাক। তারিক প্রিন্টিং সম্পর্কে আমার মতে সবচেয়ে সর্বজ্ঞ ব্যক্তি। 'জার্নিম্যান' নামে তারিকের সুখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা আছে। অসাধারণ মুদ্রণ সৌকর্য তার প্রকাশনায়। যেমন সাইজ, তেমন কাগজ, তেমন বাঁধাই। বইয়ের চরিত্র অনুযায়ী মুদ্রণ। বাংলা প্রকাশনায় এমন নজীর নাই।

তারিক সুজাত মুদ্রণ পারিপাট্যে বিপ্লব এনেছেন। তার প্রিন্টিং প্রেসে ছোটখাটো নানা ধরনের মেশিন আছে। কতো ধরনের ছাপার কলা কৌশল। বই বাঁধাইতেও অনেক নতুন আইডিয়া সংযুক্ত হয়েছে। তারিক দীর্ঘদিন ধরে প্রিন্টিং ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। তারিক নিজে অসাধারণ এক গ্রাফিক ডিজাইনার। ৯০ সালে তারিক ডাকসু নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদ প্রার্থী হন। তখন একটা নির্বাচনী পোস্টার প্রকাশ করেন। তারিকের নিজের করা অসাধারণ ডিজাইন। তারিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ছাত্রলীগ থেকে আমিও সাহিত্য সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলাম। মনে আছে শিল্পী বন্ধু ধ্রুব এষ আমার নির্বাচনী ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করে দিচ্ছিলেন। ধ্রুব একদিন বলল, আপনাকে তো ভোট দিতেই হবে। তা না হলে শুধু পোস্টারের জন্য তারিক ভাইকে ভোট দিতাম।

তারিকের গ্রাফিক ডিজাইনের এমনই শক্তি। তারিকের স্ত্রী মিমিও স্থপতি ও ইনটেরিয়র ডিজাইনার। বিভিন্ন জাদুঘরে নানা স্থাপনা নির্মাণে মিমি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু রচিত বইগুলোর তারিক প্রকাশনা তত্ত্বধারক। চীন ভ্রমণের উপর লেখা বইট 'আমার দেখা নয়া চীন' বইটির গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো তারিক সংগ্রহ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইমেলা ২০২০ উদ্বোধন কালে তারিকের কথা উল্লেখ করেন। তারিক যে অসাধ্য সাধন করেছে তা উল্লেখ করেন।
কবি তারিক সুজাত অসম্ভব ভালো মানুষ। অল্প বয়সে তার সাফল্য অনেক বেশি। দেশ টিভি, ভোরের কাগজ এর সঙ্গে সে পরিচালক হিসাবে যুক্ত।

নিরংহকারী সজ্জন ব্যক্তি। মানুষের জন্য উদার হস্ত। সাহায্য প্রার্থীকে সাহায্য করার জন্য সে ব্যাকুল থাকে। তারিক সাহায্য করে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। তারিক অসম্ভব মানবিক। কবি সাহিত্যিকদের সাহায্য সহযোগিতা করে নিয়মিত। একমাত্র কবিদের মৃত্যুতেই ভেঙে পড়তে দেখেছি তারিককে। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন- এদের মৃত্যু তারিক একেবারেই মেনে নিতে পারে না। কারো অসুখ হলে তারিক খুব উদ্বিগ্ন থাকে।

এমন ভালো মানুষ কবি কোথায় পাবো? তারিকের সঙ্গে আমার সৌহার্দ্যপূর্ণ সুন্দর সমাজ। সেই কলেজ জীবন থেকে তারিককে চিনি। তারিক ঢাকা কলেজে পড়তো আমাদের কিছুকাল পরে।
তারিক একসময় আজিমপুর কলোনীতে থাকতো। তারপর দীর্ঘকাল থেকেছে শ্যামলীতে পৈতৃক বাসায়। তারিক পেইন্টিং লাভার এবং সংগ্রাহক। অনেক মূল্যবান পেইন্টিং তার সংগ্রহে। তারিক পুরানো বইয়ের সংগ্রহাক। অফিস-বাড়ি সর্বত্র তারিকের সংগ্রহের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে আছে। আমার ধারণা তারিকের কাছে অনেক মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ আছে। যা তারিক প্রকাশ করে না। তারিকের প্রেসে শতবর্ষী পুরনো মেশিন আছে। দুষ্প্রাপ্য মেশিন। সেই মেশিনে কাজও হচ্ছে। তারিকের সৃষ্টিশীলতার আমি একজন মুগ্ধ দর্শক। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। তারিকও ওর কর্মের গল্প আমার কাছে বলে আনন্দ পায়। আমিও মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনি।

তারিককে সবাই ভালোবাসে। তারিকের বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনো কটু মন্তব্য শুনিনি। অগ্রজ কবিরা তারিককে খুবই ভালোবাসেন। আমরাও তারিকের অনুরক্ত। তার কবিতার ভক্ত। তারিকের সঙ্গে দেখা হলেই মন ভুলানো হাসি। আন্তরিকভাবে সে উষ্ণতা ছড়িয়ে কথা বলবে।

আমি দুষ্টামি করে বলব, আমার পাঁচশো টাকা কইরে? দিলি না?
তারিক বলবে, নিশ্চয়ই দেব আমীরুল ভাই। রেডি আছে।
তারিকের সাথে দেখা হলেই আমি পাঁচশো টাকা পাই। এটা আমাদের অনির্ধারিত শর্ত।
তারিকের মতো হৃদয়বান মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। বন্ধু তারিক, তুই সবসময় ভালো থাকবি। এই প্রত্যাশা।

আমীরুল ইসলাম : শিশুসাহিত্যিক

Comments

The Daily Star  | English
10-bed ICU

Life-saving care hampered in 25 govt hospitals

Intensive Care Units at 25 public hospitals across the country have remained non-functional or partially operational over the last few months largely due to a manpower crisis, depriving many critically ill patients of life-saving care.

11h ago