সুমন লেখেন মানুষ দেখে, এই সময়ে দৃষ্টি রেখে

কুঁকড়ে ওঠা মেট্রোপলিটন মন দরদের ঠিকানা খুঁজে পায় তার গানে। করপোরেট পুঁজি আর রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের নগরে, শহরতলিতে যারা বিচ্ছেদের ক্লান্ত দ্বীপে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন, সুমনের গান হয়ে ওঠে তাদের গান।
কবির সুমন। ছবি: সংগৃহীত

প্রেমকে তিনি দীক্ষিত করেছেন আগুনের প্রবণতায়। আর মানবীয় মূল্যবোধগুলো পুনর্বিন্যাসে এমন সব গান বেঁধেছেন, যার নজির আগে দেখেনি কেউ।

কুঁকড়ে ওঠা মেট্রোপলিটন মন দরদের ঠিকানা খুঁজে পায় তার গানে। করপোরেট পুঁজি আর রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের নগরে, শহরতলিতে যারা বিচ্ছেদের ক্লান্ত দ্বীপে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন, সুমনের গান হয়ে ওঠে তাদের গান।

ভারতীয় উপমহাদেশের আরও অনেক প্রাজ্ঞ-গুণী শিল্পীর মতো স্বর্ণকণ্ঠ নন হয়তো কবির। তবে এ কণ্ঠই ইস্পাতপ্রত্যয়ে ঘা মারে বিবেকের বুকে। সেখানে পাওয়া যায় রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকারের শিল্পিত স্বভাব।

তাই সুমন নিজেই সুরে-কথায় বলে দেন তার গানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। লেখেন, 'পদ্য লিখি মানুষ দেখে।/এই সময়ে দৃষ্টি রেখে/শব্দ খেলাই।'

ছবি: সংগৃহীত

আজ গানওলার ৭৫তম জন্মদিন। ৩০ বছর আগে 'তোমাকে চাই' অ্যালবামের ভেতর দিয়ে বাংলা গানের জগতে নতুন যে ধারার সূচনা হয়েছিল, সেই ধারার পুরোধা সুমন ১৯৪৯ সালে সুরিন্দ্রনাথ এবং উমা চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে ওড়িশার কটকে জন্ম নেন।

শৈশবে পিতার কাছে ধ্রুপদী সংগীতের তালিম পান সুমন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ালেখা করেন। পেশাগত জীবনের শুরুর দিকে কাজ করেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। পরে জার্মানিতে একজন রেডিও সাংবাদিক হিসেবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এ সময়কালে তিনি ফ্রান্সে বব ডিলানের গান শোনেন, যা বাংলা গান নিয়ে সুমনের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এরপর ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন সুমন। সেখানে ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগে কর্মরত ছিলেন তিনি। এখানে সুমন পিট সিগার এবং মায়া আঙ্গেলউসহ বেশ কিছু সংগীতধর্মী এবং সাহিত্যানুগ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। কাছাকাছি সময়ে পিট সিগারের বাবা নিকারাগুয়ার এরনেস্ত চারদেনালের কাছ থেকে তিনি নেন বিপ্লবের পাঠ। আসেন লাতিন আমেরিকার নতুন গানের আন্দোলনের সংস্পর্শে।

ছবি: সংগৃহীত

এসব অভিজ্ঞতার মিশেলে সুমনের গান তাই সুরের কল্প থেকে বেরিয়ে এসে হয়ে ওঠে দর্শন। নিজের বিভূতিতেই বারবার জ্বলে ওঠেন তিনি। গড়িয়াহাটের মিনিবাস কন্ডাক্টর থেকে ফুলমণী ইসরাত, ফেলানি খাতুন, তাপসী মালিক, ছত্রধর মাহাতো, শাহবাগ, গুয়াতেমালা, গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স- এ সবকিছুই হয়ে ওঠে তার গানের অনুষঙ্গ, হয়ে ওঠে রক্ত-ঘাম-ঈর্ষা-প্রেমে মাখা একেকটি আখ্যান।

আবার এখনকার আধুনিক বাংলা কবিতার আলোকিত বিজ্ঞাপন জয় গোস্বামীর কাছে সুমন একজন কবি। তার ভাষ্য, 'সুমনের গান সুর ছাড়াই পাঠ করা যায়, কারণ তা উৎকৃষ্ট কবিতা।'

'নাগরিক কবিয়াল' সুমনের গান নিয়ে জয় গোস্বামীর মূল্যায়ন হলো, 'সুমন একা হাতে বাংলা গানের দিক বদল ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে অনেক শক্তিমান গীতিকার ও ‍সুরকার এসেছেন। কিন্তু কেউই বাংলা গানের ক্ষেত্রে সুমন যে বিপ্লবটা ঘটালেন সেই কাজটা করতে পারেননি। এখানে সুমন অনন্য।'

ছবি: সংগৃহীত

সময়ের বলিষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুমন ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে ওড়িশায় খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও সমাজসেবী গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনস ও তার ২ শিশুপুত্রকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে ধর্ম পরিবর্তন করে চলে আসেন 'সংখ্যালঘুর দলে'। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে হয়ে যান কবির সুমন।

আবার ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার প্রতিবাদে সুমন মৌলবাদের বিরুদ্ধে গান রচনা করেন, নন্দীগ্রাম গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনে সামিল হন। ২০০৯ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সরাসরি নামের রাজনীতির মাঠে।

এ সময়কার একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আজ বৃহস্পতিবার ভারতের একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুমন বলেন, 'আমি একমাত্র সাংসদ, যার কোনও গাড়ি ছিল না। অন্যের গাড়ি ব্যবহার করতাম। এখনও আমার গাড়ি নেই। পাড়ার সিপিএমের ছেলেরা খুব রসিক। ওরা বলত, ''গুরু, তুমি নিজের জন্য একটা সাইকেল পর্যন্ত কেনোনি। তুমি আবার আমাদের জন্য কী করবে!'''

ছবি: সংগৃহীত

অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী সময়ে কবীর সুমন আধুনিক বাংলা গানে সবথেকে বড় ঘটনা। সুমন যতটা পশ্চিমবঙ্গের, তার চেয়েও বেশি বাংলাদেশের। তার গানে বাংলাদেশ যেভাবে মূর্ত হয়েছে, কোনো বাংলাদেশির গানেও তা হয়নি।

গত বছরের অক্টোবরে ১৩ বছর পর বাংলাদেশ সফরে এসে সুমনও গানে-কথায় জানিয়ে দেন বাংলাদেশের প্রতি তার তীব্র অনুরাগের কথা। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগেও একবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসে গান করেছিলেন তিনি। সেবার টিকিট বিক্রির পুরো অর্থ তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিলে দিয়েছিলেন।

ছবি: সংগৃহীত

আজ গানে-প্রাণে ৭৫টি বসন্ত পেরিয়ে এলেন কবির। একবার 'এক মুহূর্তে' শিরোনামের একটি গানে তিনি লিখেছিলেন, 'বয়েস বলে, "বাড়ছি দেখো"/মৃত্যু বলে, "কাছেই আছি"/জীবন বলে, "কোথায় জীবন?/খেলছি শুধু কানামাছি"।'

সুমনের এই খেলা চলতে থাকুক। এর ভেতর থেকেই তার শ্রোতা-পাঠকরা নিশ্চয় জীবনকে খুঁজে নেবেন। শুনে নেবেন না বলতে পারা কথাগুলো। 

শুভ জন্মদিন গানওলা…।

 

Comments