বাইপোলার ডিজঅর্ডার কী, চিকিৎসায় করণীয়
বাইপোলার ডিজঅর্ডার এক ধরনের মানসিক রোগ। এটাকে এক্সট্রিম মুড সুইংও বলা হয়। মুড সুইং যে কারো হতেই পারে। তবে, ঘনঘন এবং দীর্ঘদিন যাবৎ মুড সুইং হলে তা অস্বাভাবিক।
বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্তরা কখনো কখনো দীর্ঘসময় বিষণ্ণ থাকেন, আবার দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ শুরু করেন এবং অতিরিক্ত হাসিখুশি বা উচ্ছ্বাস প্রবণ হয়ে ওঠেন।
দীর্ঘসময় ধরে কারো এমন অবস্থা চলতে থাকলে সেটাকে বাইপোলার ডিজঅর্ডার হিসেবে শনাক্ত করেন চিকিৎসকরা।
এ বিষয়ে জানতে আমরা কথা বলেছি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকারের সঙ্গে।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার কী?
এটি এমন একধরনের মানসিক রোগ, যা মানুষের আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন তৈরি করে।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার ২ ধরনের। একজন মানুষের মানসিকতার এক প্রান্তে থাকে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস প্রবণতা, যাকে চিকিৎসকরা বলেন ম্যানিয়া এপিসোড। এমন রোগী অতিরিক্ত উৎফুল্ল থাকেন, কথা বেশি বলেন, অনেক সময় জিনিসপত্র বিলিয়ে দেন।
আরেকপ্রান্তে থাকে তার বিষণ্ণতা, যাকে চিকিৎসকরা বলেন ডিপ্রেশন এপিসোড। এই সময় তার কিছুই ভালো লাগে না, হতাশায় ভোগেন। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।
এখানে 'এপিসোড' শব্দটি ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের এই ২ ধরনের আচরণের যেকোনো একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে পারে। এই সময়কাল ২-৩ মাস পর্যন্ত হতে পারে বলে এটাকে 'এপিসোড' হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার কেন হয়?
এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি৷ তবে সম্ভাব্য কিছু কারণ উঠে এসেছে৷ সেগুলো হলো:
১. মানসিক গঠনগত সমস্যা
২. জিনগত
৩. শরীরে প্রয়োজনীয় হরমোনের ঘাটতি
৪. একাকিত্ব ভর করা
৫. পরিবার থেকে অবহেলা
৬. বড় কোনো মানসিক চাপ
৭. অনেক বছর আগের মানসিক ধাক্কার ঘটনা মনে পুষে রাখা
উপসর্গ
বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের লক্ষণ ২ ধরনের। একই মানুষের মধ্যে সময়ের ব্যবধানে পরস্পর বিপরীত আচরণ দেখা গেলে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
উপসর্গ ১: ম্যানিয়া এপিসোড
● অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ, অতি উৎফুল্ল
● অতিরিক্ত কথা বলা
● নিজেকে বিশাল শক্তিশালী, ক্ষমতাশালী মনে করতে শুরু করা
● হাই এনার্জি বা অতিরিক্ত কাজের প্রবণতা
● খাবারে অনীহা
● অযৌক্তিক দাবি করা
● নিদ্রাহীনতা
● হঠাৎ রেগে যাওয়া, ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারি করা
● বেপরোয়া মনোভাব
● বেশি বেশি খরচ করতে শুরু করা, অদরকারি জিনিসপত্র কিনতে চাওয়া
● মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
● যৌনস্পৃহা বেড়ে যাওয়া
● নিজের জিনিসপত্র অন্যদের বিলিয়ে দেওয়া
উপসর্গ ২: ডিপ্রেশন ডিজঅর্ডার
● দীর্ঘসময় বা দীর্ঘদিন হতাশায় ভোগা
● বিনা কারণে কান্নাকাটি করা, উদ্বিগ্ন হওয়া
● আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা
● নিজেকে ক্ষুদ্র, তুচ্ছ বলে মনে করা
● আত্মহত্যার প্রবণতা, জীবন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
● কোনো ঘটনাতেই খুশি না হওয়া
● খাবারের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা বা অতিরিক্ত খাবার খাওয়া
● অতিরিক্ত ক্লান্তি
● অপরাধ বোধ, নিজেকে দোষী ভাবা
● যৌনস্পৃহা কমে যাওয়া
● স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
নিয়ন্ত্রণের উপায়
এখন পর্যন্ত বাইপোলার ডিজঅর্ডার সম্পূর্ণ নিরাময়ের পদ্ধতি পাওয়া যায়নি জানিয়ে ডা. মেখলা সরকার বলেন, 'এই রোগটি ডায়াবেটিসের মতো, যা কখনো নির্মূল করা যায় না। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।'
এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রোগীর পরিবারের সদস্যের ভূমিকা মুখ্য। পরিবারের সদস্যদের রোগীর কাজকর্মের ওপর নজর দিতে হবে। রোগী কোনো ভুল করলে তাকে কঠোরভাবে কিছু বলা যাবে না৷
রোগীর কোনো ইচ্ছেতে সরাসরি 'না' বলা উচিত হবে না, তর্ক করা যাবে না। প্রয়োজনে কৌশল অবলম্বন করে অন্যদিকে তার মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে হবে।
রোগীকে সঙ্গ দিতে হবে এবং ধীরে ধীরে বুঝাতে হবে, যদিও ম্যানিক এপিসোডে রোগী খুবই বেপরোয়া থাকে। তাদের নিয়মিত খাওয়ানো ও ঘুমানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
মেখলা সরকার বলেন, 'বাড়িতে রোগীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দ্রুত হাসপাতালে আনতে হবে। হাসপাতালে রোগীকে প্রাথমিক পর্যায়ে মুড স্টেবিলেইজার এবং অ্যান্টি-সাইক্রিয়েটিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রয়োজনে ঘুমের ওষুধও দেওয়া হয়।'
সতর্কতা
বাইপোলার ডিজঅর্ডারের রোগীকে পুরো এপিসোডে কেবলমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কিংবা ইন্টারনেটের তথ্য থেকে রোগীকে কোনো ওষুধ দেওয়া উচিত হবে না।
Comments