প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডার: কাদের ও কেন হয়, লক্ষণ কী
অনেক নারীই জানেন না তিনি প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডারে (পিএমডিডি) ভুগছেন। পিরিয়ডের সময়টা সহজ করে তুলতে এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।
প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডার সম্পর্কে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহানারা চৌধুরী।
প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডার (পিএমডিডি) কী
ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডার (পিএমডিডি) হলো প্রি-মেনস্ট্রুয়াল সিন্ড্রোমের (পিএমএস) একটি গুরুতর রূপ। পিরিয়ডের আগে আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে পিএমএসের উপসর্গ দেখা যায়। প্রি-মেনস্ট্রুয়াল সিন্ড্রোমের শারীরিক ও বিশেষ করে মানসিক বিপর্যয়গুলো যখন অনেক বেশি গুরুতর হয় তখন তাকে প্রি- মেনস্ট্রুয়াল ডিজফোরিক ডিসঅর্ডার বলা হয়।
পিএমডিডি কাদের ও কেন হয়
অনেক নারীর পিরিয়ডের ১০ থেকে ১২ দিন আগে থেকে পিএমডিডি শুরু হয়। তখন শারীরিক ও মানসিক কিছু উপসর্গ দেখা যায়। মূলত মানসিক কিছু কিছু সমস্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়, যেটা অন্য সময় তার থাকে না।
সাধারণত একজন নারীর পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর ১৪ বছর বয়স থেকে শুরু করে পিরিয়ড শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত পিএমডিডি হতে পারে। তবে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে বেশি হয়। এই বয়সসীমার পরেও হতে পারে, আবার আগেও হতে পারে। যে সময় নারীদের পিরিয়ড নিয়মিত হয়, ঋতুচক্র চলে এবং সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা থাকে, তখন অনেকেই এতে ভুগতে পারেন।
ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, পিএমডিডি কেন হয় তার সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে কিছু কিছু ধারণা থেকে বলা হয় যে, একটা মেয়ের ঋতুচক্র সাধারণত এক মাস। সেই সময় ডিম্বাশয় থেকে ডিম যখন পরিস্ফুটিত হয় তখন মেয়েদের শরীরে কিছু হরমোনের তারতম্য হয়। এই হরমোনের তারতম্যের কারণে প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডার হয়। মূলত এস্ট্রোজেন হরমোন সারা মাসই থাকে, সঙ্গে প্রোজেস্টোরেন নামক হরমোন তৈরি হয়।
মস্তিষ্কের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালানোর জন্য কতগুলো হরমোন থাকে আলাদা যেটাকে বলে নিউরোট্রান্সমিটার, যেমন- সেরোটোনিন, এপিনেফ্রিন, নর এপিনেফ্রিন। এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টোরেন হরমোন মিলিতভাবে সেরোটোনিন, এপিনেফ্রিন ও নর এপিনেফ্রিন হরমোনের মধ্যে তারতম্য ঘটায়। যার ফলে প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডারের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
এ ছাড়া অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, ইটিং ডিজঅর্ডার যেমন- অতিরিক্ত খাওয়া, কম খাওয়া, রিলেশনশিপজনিত সমস্যা এসব কারণেও হতে পারে।
পিএমডিডির লক্ষণ
ডা. সাহানারা চৌধুরী বলেন, পিএমএসের সময় শারীরিক লক্ষণ বেশি থাকে। আর পিএমডিডিতে মানসিক সমস্যার বেশি প্রতিফলন ঘটে। যেমন-
১. গুরুতর ক্লান্তি লাগা
২. মেজাজের পরিবর্তন
৩. মুড সুইং হয়
৪. খিটখিটে ভাব, রাগ, বিরক্তি
৫. প্রচণ্ড উদ্বেগ, হতাশা, বিষণ্নতা
৬. অকারণে কান্নাকাটি করা
৭. কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারে না, কোনো কাজ সমন্বয় করে করতে পারে না
৮. বুক ধরফর করে
৯. মনে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা হয়, কারো সঙ্গে কথা বলায় অনীহা দেখা দেয়
১০. পিএমডিডি গুরুতর হলে অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। কিছু ভালো লাগে না, মরে যেতে ইচ্ছে হয় এরকমও হতে পারে।
পিএমডিডির শারীরিক লক্ষণও রয়েছে। যেমন-
১. পেট ফুলে যায়
২. খাদ্যনালীর প্রদাহ হতে পারে, ইটিং ডিজঅর্ডার হতে পারে।
৩. প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, মাইগ্রেন, মাথা ঘোরায়
৪. পিঠে ব্যথা হতে পারে
৫. অনেক সময় খিঁচুনি দিয়ে অচেতন হয়ে যেতে পারে
৬. পেশিতে ক্র্যাম্প হতে পারে
৭. হটফ্ল্যাশ হয় অর্থাৎ হঠাৎ খুব গরম ঝলকানি লাগে শরীরে
৮. ঘুম আসে না, দৃষ্টিশক্তিতে পরিবর্তন আসে, অনেক সময় শ্বাসকষ্ট হয়, অ্যালার্জি হয়।
প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডারের সমস্যাগুলো সবসময় থাকে না। পিরিয়ড শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে শুরু হয়, আবার পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর কমে যায়।
পিএমডিডির চিকিৎসা
পিএমডিডি যাদের আছে তাদের কাউন্সিলিং করতে হবে, পিরিয়ডের সময় শারীরিক সমস্যাগুলো থাকবে তা বোঝাতে হবে। ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার বা ওষুধ খেতে হবে। চা, কফি এবং ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত রোদে যাওয়া যাবে না। ব্যায়াম, ইয়োগা ও মেডিটেশন করতে হবে।
সেরোটোনিন হরমোনের মাত্রা বাড়ানোর জন্য ওষুধ দেওয়া যেতে পারে প্রয়োজনে। মাত্রাতিরিক্ত বিষণ্নতা ও ঘুমের সমস্যায় অবস্থা বুঝে ওষুধ দেওয়া যেতে পারে৷
মূলত ওষুধ ছাড়া জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করে প্রি-মেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা করার কথা বলেন ডা. সাহানারা চৌধুরী।
Comments