লিংকন মেমোরিয়াল থেকে ক্যাপিটল বিল্ডিং: ওয়াশিংটন ডিসিতে ভ্রমণের কয়েকটি দিন

ওয়াশিংটন ডিসি ভ্রমণ
ছবি: নাদিয়া রহমানের সৌজন্যে

গ্রীষ্মের শেষ সময়ে টানা দু-তিন মাস সামার জব শেষে ওয়াশিংটন ডিসির টিকিট কাটলাম। আমার স্কুল থেকে একমাত্র গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসেবে গিয়েছিলাম যোগাযোগ এবং সাংবাদিকতার অন্যতম বড় কনফারেন্স এজেএমসিতে। আমার অ্যাডভাইজর যারপরনাই খুশি ছিলেন, কারণ আমার গবেষণা কাজ সেখানে নির্বাচিত হয়েছিল পুরো বিভাগের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে। এটাই ছিল কেন্টাকির ছিমছাম, গোছানো সবুজ শহর লেক্সিংটনের বাইরে প্রথম আমার কোথাও একাকী যাত্রা।

মনে আছে, সামারে টিচিং অ্যাসিসট্যান্টশিপের বাইরে যে দুটো জব করেছি, তার থেকে জমানো টাকা দিয়েই টিকেট কেটেছিলাম। টানা কয়েক মাসের পরিশ্রম শেষে, গবেষণা এবং ভ্রমণ হিসেবে এই যাত্রা ছিল স্বস্তিদায়ক। আমার বিভাগও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিল, বিশেষ করে কনফারেন্সের ফান্ড নিয়ে। অতঃপর কাজ এবং কাজের মধ্যেই তিন দিন যেটুকু সময় পেয়েছি তার মধ্যেই আমার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ঘুরে দেখা।

ইতিহাসের প্রতীক, লিংকন মেমোরিয়াল এবং ওয়াশিংটন মনুমেন্ট

বিশাল এই মেমোরিয়ালটি শুধু মার্কিন রাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নির্মিত হয়নি, বরং এটি মার্কিন সমাজের নানা সংকট, সংগ্রাম ও অভ্যুদয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেমোরিয়ালটি প্রথমে দেখেই মনে হয়েছিল এর দৃঢ় স্থাপত্য নিয়ে। গ্রিক ধাঁচের সাদা মার্বেল থেকে নির্মিত এক বিশাল টেম্পলের মতো। এরই মাঝে লিংকনের ভাস্কর্যটি দেখে মনে হয় যেন ইতিহাস একে জীবন্ত করে তুলেছে। লিংকনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তার শান্ত, কিন্তু দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে এর মাধ্যমে।

মেমোরিয়ালের পাশ দিয়েই বিস্তৃত দীর্ঘ সবুজ এক মাঠ, যেখানে আমরা দুদণ্ড বসে ছিলাম বিশ্রামের জন্য। এই মেমোরিয়ালের এক দিকে রয়েছে এম্পিথিয়েটার, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা এবং প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে বহু বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে, এখানে দাঁড়িয়ে ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তার ঐতিহাসিক 'আই হ্যাভ আ ড্রিম' বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ
ছবি: নাদিয়া রহমানের সৌজন্যে

আমরা যখন পড়ন্ত বিকেলে মাঠে বসে ছিলাম, তখন সূর্যের ঠিক বিপরীতে মেমোরিয়ালের ঠিক উল্টো পাশে শ্বেত রঙের ওয়াশিংটন মনুমেন্ট আর ন্যাশনাল মল চোখে পড়ছিল। ওয়াশিংটন মনুমেন্ট আসলে প্রায় ৬০০ ফুট উচ্চতার এক বিশাল পিরামিড আকৃতির টাওয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যই এই মনুমেন্টের কাজ শুরু হয় ১৮৪৮ সালে, যা শেষ হয় ১৮৮৪ সালের দিকে এসে। এই মনুমেন্টের চূড়ায় উঠলে পুরো শহরের এক অসাধারণ দৃশ্য মেলে, যা জীবন্ত এক ইতিহাসের আভাস দিতে থাকে। আমার এক অধ্যাপক জানিয়েছিলেন ওয়াশিংটন ডিসির রাজপথ বা অ্যাভেনিউ, বিভিন্ন ভাস্কর্যগুলো ইউরোপের শিল্পী-স্থাপত্যবিদদের হাতে নির্মাণ করা। তাই ইউরোপের নানান দেশের বড় শহরগুলোর রাজপথের সঙ্গে ডিসির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

হোয়াইট হাউস

আমরা দ্বিতীয় দিন গিয়েছিলাম হোয়াইট হাউসে। মনুমেন্টের মতোই শ্বেত মার্বেল পাথরে, একই গ্রীক শৈলীতে নির্মিত এই বাসভবন। ইতিহাসকে ছাড়িয়ে দেখলাম এই হাউস নিয়ে সাধারণ জনগণের আগ্রহের শেষ নেই। যদিও হোয়াইট হাউসের ভেতরে সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকারের জন্য কঠোর নিয়মকানুন রয়েছে, তবে মার্কিন নাগরিকরা বিশেষ দিবসে বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রম এবং অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করতে পারেন। এত ভিড় এবং ছবি তোলার জন্য অপেক্ষারত বহু মানুষ, সবকিছু মিলিয়ে আমাদের কাছে লিংকন মেমোরিয়াল আর ওয়াশিংটন মনুমেন্ট ভালো লেগেছিল বেশি। আমি আর আমার গবেষণা কাজের আরেকজন লেখক, দুজনই দু-একটা ছবি তুলেই চলে এসেছিলাম এবং এই দু-একটা ছবির জন্যও আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ।

আরও যা দেখলাম  

ক্যাপিটল বিল্ডিং যা মার্কিন আইনসভা কেন্দ্র, এই দর্শনীয় স্থানটিকেও আমরা রেখেছিলাম আমাদের তালিকায়। ইতিহাস এবং স্থাপত্য নিয়ে আমার কোনো রকম ক্লান্তি নেই বলেই হয়তো ক্যাপিটল বিল্ডিংও বেশ ভাল লেগেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের কেন্দ্র হিসেবে এখানে নানা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নীতি নির্ধারণের মতন কাজগুলো সম্পন্ন হয় এখানে। এই ভবনটি মূলত মার্কিন কংগ্রেসের সিংহদ্বার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা, সিনেট এবং হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে।

গণতন্ত্রের প্রতীক, এই ক্যাপিটল বিল্ডিং যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই ভবনটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৭৯৩ সালে, আর তার নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয় ১৮২৬ সালে। পিটার লুইজ হেনরি বেকন এবং থমাস উইলসনের মতো অগ্রগামী স্থপতিরা এই ভবনটির নকশা করেছিলেন। এর স্থাপত্য শিল্পের নকশা গ্রিক ও রোমান প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত, যা সহজেই প্রতিফলিত হয়। যেমন বিশাল গম্বুজটির শীর্ষে রয়েছে স্ট্যাচু অফ ফ্রিডম, যা সাংবিধানিক ভিত্তির প্রতীক। গম্বুজের নিচের অংশে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের চিত্রকর্মও সাজানো রয়েছে সেখানকার ইতিহাস তুলে ধরার জন্য। বিশাল সিঁড়ি এবং তার মধ্যে চতুর্দিকের প্রাসাদময় কাঠামো, পুরো ভবনটিকে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা দৃঢ় এক বিশালতার প্রতীক হিসেবেই তুলে ধরে।

 

Comments

The Daily Star  | English
Reform commission reports' submission

We never got a chance to reform our state and politics like now. Let’s not waste it

Our initial study of the reports of the four commissions indicates that the recommendations are quite substantive.

14h ago