ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট ক্যাম্পাসে
কনফারেন্সে গবেষণা উপস্থাপনের জন্য আমার দ্বিতীয় সোলো ট্যুর ভারতের ওডিশার ভুবনেশ্বরে, ডিসেম্বরের হিম শীতের সময়। নির্দিষ্টভাবে গন্তব্য ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অফ ইনডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজিতে। ঢাকা থেকে প্রথমে কলকাতা, তারপর সেখান থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা উড়োজাহাজ যাত্রার পর ভুবনেশ্বরে যখন পৌঁছেছি তখন রাত ১১টার বেশি।
দেখলাম, বাইরে আমার অধ্যাপক দাঁড়িয়ে আছেন আমার জন্য। সারা দিন যাত্রার পর নিজ দেশের শিক্ষক মানুষকে দেখায় একটা শান্তি কাজ করছিল। যাই হোক, ভুবনেশ্বর বিখ্যাত সেখানকার বিভিন্ন মন্দির যেমন দক্ষিণেশ্বর, লিঙ্গরাজ, উদয়গিরি ও খাণ্ডগিরি গুহার জন্য। এছাড়াও ওডিশার প্রধান তীর্থস্থান পুরী আর সেখানকার জগন্নাথ মন্দিরও বিখ্যাত।
আমাদের এই ভ্রমণ স্থানগুলো ঘুরে দেখা হলেও সব থেকে বেশি মনে করি শীতকালীন শান্ত এক আবহে কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অফ ইনডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজির গেস্ট হাউজে থাকার তিনটা দিনের কথা। অতিথি ভবনে ভোরে ঘুম ভাঙত পায়রার ডাকে। উঠে কাঠের জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যেত এই কুয়াশামাখা ভোরে পায়রাগুলো বসে আছে ভবনের টালি দেওয়া ছাদে।
১৯৯২ সালের দিকে গড়ে ওঠা কলিঙ্গ ইন্সটিটিউটটি আবাসিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে প্রায় ৪০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। একেবারে ভোর থেকেই শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততা শুরু হতে দেখেছি, যা চলে একদম মাঝরাত পর্যন্ত। আমাদের নিজেদেরও কনফারেন্সের কাজে সকাল থেকে সন্ধ্যা বেশ ব্যস্ততায় পার হয়ে গিয়েছিল।
সন্ধ্যার পর যখন কুয়াশা নামত তখন অবসর মিলত। শীতকাল ছিল তাই সেখানকার স্থানীয় সাংস্কৃতিক আয়োজন দেখেছি প্রতি সন্ধ্যায়। এছাড়াও ক্যাম্পাসের মাঝে শিক্ষার্থীরা গিটার বাজিয়ে, কোথাও একসঙ্গে বসে বিতর্ক-আলোচনা করে যাচ্ছে সেটাও দেখেছি। অনেকটা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসের মতোই পরিবেশ। তবে যেই বিষয়টা ভিন্ন দেখলাম, সেখানে মেয়েদের হল কিংবা ডর্মে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া নেই। রাতের যে কোনো সময়ে ক্যাম্পাসের যে কোনো কাজ সেরে ডর্মে যাওয়ায় বিধিনিষেধ নেই।
পড়ন্ত বিকেল কিংবা সন্ধ্যা নাগাদ বের হলেই দেখেছি, ক্যাম্পাসের একেকটা জায়গা বিভিন্ন রঙের ফুল পড়ে পথ ঢেকে আছে। কখনো কনফারেন্স ভবন থেকে গেস্ট হাউজে ফেরার পথটা একেবারেই নির্জন হয়ে থাকত। শীতের কুয়াশা, দুপাশে অন্ধকারে বিশাল গাছপালা আর হেঁটে যাওয়ার পথটুকুতে হলদে আলো। নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়নি কখনো।
এই ক্যাম্পাসের আরেকটি বিষয় মনে পড়ে, আমাদের নিজেদের আড্ডা। আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে অংশ নিয়েছি তাদের আড্ডা। যখন শীতের রাতে ফায়ার প্লেসের সামনে বসে, মাফলার-চাদর জড়িয়ে, চা-কফি হাতে আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন শিক্ষার্থী-শিক্ষকের দূরত্বটা ছিল না। একেক দেশের সংস্কৃতি, খাবার, গানের আলোচনার মধ্যে দ্রুতই মধ্যরাত হয়ে যেত, আর গেস্ট হাউজের ঘণ্টা বেজে উঠত।
দিন খুব দ্রুতই কেটে গিয়েছিল, নানান ব্যস্ততা, শহর ঘুরে দেখা আর সান্ধ্যকালীন এই আড্ডায়। এরপর শিগগির দেখা করার পরিকল্পনা করলেও বেশিরভাগের সঙ্গেই আর দেখা হয়নি। মাঝে করোনাকালে তো সবকিছু একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু বিদায় নেওয়ার সময় আমরা কেউই জানতাম না, এই শীতকালীন কুয়াশার সন্ধ্যাগুলোয় আমুদে আড্ডাগুলো সহসাই আর ফিরবে না।
Comments