ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে কী করবেন

ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইল

ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চিন্তা করে সবাই। কিন্তু অনেকেই জানেন না কীভাবে কী করতে হবে।  

এই সম্পর্কে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মমতাজ পারভীন।

ব্যক্তিগত ছবি ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইল কীভাবে হয়

আইনজীবী মমতাজ পারভীন বলেন, সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং অনলাইন থেকে ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে ব্ল্যাকমেইল করা- ইদানীং দুটো ক্ষেত্রেই ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা বেশি ঘটছে। বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইলের ফাঁদে ফেলেন সাইবার অপরাধীরা।

১. সাইবার অপরাধী ও প্রতারকরা বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছবি বা ভিডিও নিয়ে সেগুলো বিকৃত করে, ভুয়া বা ফেইক আইডি খুলে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে, ছবি ও ভিডিও ম্যানিপুলেট করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তারা টাকা দাবি করে, ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে এবং অনেক সময় আপত্তিকর কিছু করতে বাধ্য করায় ভুক্তভোগীকে।

২. ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও নিয়ে আরেক ধরনের ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা ঘটে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে। সেটি স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে করতে পারে, আবার কারো সঙ্গে সম্পর্কে থাকার সময়ে ব্যক্তিগত কোনো মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও থাকলে পরে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হন অনেকে।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও শেয়ার করছেন প্রায় সব বয়সী মানুষ। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন- ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি আইডির সিকিউরিটি সিস্টেম ঠিক থাকে না। যে কারণে যে কেউ ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করতে পারছে অনায়াসে এবং ব্ল্যাকমেইলের মতো ঘটনা ঘটছে।

আইনি ব্যবস্থা নিতে করণীয়

আইনজীবী মমতাজ পারভীন বলেন, ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হওয়া সবচেয়ে বেশি জরুরি। সবসময় মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ।

১. ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে কোনোভাবেই ভয় পাওয়া যাবে না। ভয় পেয়ে সাইবার অপরাধী, প্রতারকদের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।

২. অনলাইনে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে তার প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে। যেমন- মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামে হয়রানির শিকার হলে সাইবার অপরাধীর মেসেজ, চ্যাট, কল রেকর্ড অথবা ছবি-ভিডিওর স্ক্রিনশট এবং আইডি লিংক সংরক্ষণে রাখতে হবে।

৩. কেউ যদি ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও ম্যানিপুলেট করে পর্নোগ্রাফি বানায়, গোপন ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয় তাহলে পর্নোগ্রাফি আইনে সরাসরি মামলা করতে পারবেন ভুক্তভোগী। এছাড়া সাইবার ট্রাইব্যুনালে গিয়ে মামলা করতে পারবেন আইনজীবীর মাধ্যমে। যদি ভুক্তভোগী থানায় মামলা করতে চান তাহলে সরাসরি নিজে গিয়েই অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন কিংবা জিডি করতে পারবেন। তবে এ ধরনের ঘটনায় পর্নোগ্রাফি মামলা করাই ভালো।

৪. ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও নিয়ে হুমকি দিলে, ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করলে থানায় জিডি করতে হবে। একইসঙ্গে ভুক্তভোগী নারী হলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে নারী সুরক্ষা ইউনিট আছে, সেখানে জিডির কপি দিয়ে আসতে হবে, সেখানে যোগাযোগ করে বিষয়টি অবহিত করতে হবে।

https://www.police.gov.bd/en/police_cyber_support_for_women এখানে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নারীদের জন্য সাইবার সাপোর্টের হটলাইন, ইমেইল অ্যাড্রেস আছে।

https://www.facebook.com/share/1XisDVtAss/ পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত পেইজ, এর মেসেঞ্জারেও অভিযোগ জানানো যায়।

৫.  এছাড়া হটলাইন নম্বর ৯৯৯ এ কল করেও সহায়তা নেওয়া যাবে।

৬.  সরাসরি সাইবার বুলিং করলে, হুমকি দিলে, ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যাবে। সাইবার ট্রাইব্যুনাল শুধু বিভাগীয় শহরগুলোতে আছে, কোনো জেলা শহরে নেই। কেউ সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে চাইলে তাকে সরাসরি বিভাগীয় শহরে করতে হবে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রথমত থানায় জিডি করতে পারেন ভুক্তভোগী যদি হুমকি দেয়। আর যদি অনলাইনে ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে দেয় তাহলে সাইবার অপরাধীর অপরাধের প্রমাণ ও আইডি লিংক নিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

সচেতনতায় করণীয়

১. অনলাইনে ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার সবচেয়ে বেশি হয় টিনএজাররা। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এমনভাবে, যাতে সেটি সন্তানদের মনে বিরূপ মনোভাবের কারণ না হয়।

২. টিনএজার কোনো সন্তান যদি তার সমস্যার কথা বাবা-মা বা অভিভাবকের সঙ্গে শেয়ার করতে না পারে, সে হয়তো তার কোনো বন্ধু বা বাইরের কারো সঙ্গে শেয়ার করবে। এতে করে সমস্যা আরো বাড়তে পারে, ভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে পারে ভুক্তভোগী।

৩. ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার ভুক্তভোগীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে তার পাশে দাঁড়াতে হবে, যত ধরনের আইনী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সেগুলো নিতে হবে।

৪. সমাজের ভয় করা যাবে না। ব্ল্যাকমেইলের শিকার এই খবর জানলে সমাজ হেয় করবে, খারাপ মনে করবে এসব ভাবনা থেকে দূরে থাকতে হবে। সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে সমাজের অন্যরাও যাতে ব্ল্যাকমেইলের শিকার না হয় সেজন্য সাইবার অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

৫. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। সোশ্যাল সাইটে যত অ্যাকাউন্ট বা আইডি আছে সেগুলোতে যত ধরনের সিকিউরিটি আছে সব যুক্ত করতে হবে। অপরিচিত, একদম ব্যক্তিগত পরিচিতির বাইরে কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট না পাঠানো কিংবা গ্রহণ না করা বা তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় যাওয়া একেবারেই উচিত নয়।

৬. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোন গ্রুপে, পেইজে, চ্যাট গ্রুপে যুক্ত হচ্ছি, কী ধরনের কার্যক্রম করছি সেগুলোর বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে সবসময়। অনেক ভুয়া এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রুপ, আইডি থাকে যার ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ খুঁজে এবং ফাঁদ পাতে।

৭. ছবি, ভিডিও আপলোড করার ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে, কেউ যাতে সেগুলো ডাউনলোড কিংবা স্ক্রিনশট নিতে না পারে সেজন্য সব ধরনের সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে হবে। যেকোনো লিংক ক্লিক করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৮. বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কারো সঙ্গে পরিচয়ের পর দেখা করার জন্য ডাকল কোনো রেস্তোরাঁ, হোটেল, রিসোর্ট কিংবা বাড়িতে আর চলে গেলাম, এই কাজ কখনোই করা যাবে না। কারণ এসব ক্ষেত্রে আটকে রেখে ছবি, ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। সেজন্য সাবধান থাকতে হবে।

৯. ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সচেতন থাকতে হবে। কোথাও গোপনে ভিডিও হচ্ছে কি না, কেউ ছবি তুলছে কি না খেয়াল রাখতে হবে। কেউ ছবি চাইলেই দেওয়া যাবে না।

১০. বিভিন্ন ট্রায়াল রুমে, পাবলিক টয়লেট, হোটেলে অনেক সময় গোপন ক্যামেরা থাকে, যার মাধ্যমে সাইবার ক্রাইমের ঘটনা ঘটে। সেজন্য যতটা সম্ভব সচেতন থাকতে হবে নিরাপত্তার বিষয়ে।

অনলাইন ব্ল্যাকমেইল, সাইবার ক্রাইম, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে অবশ্যই আইনগত সহায়তা নিতে হবে। অপরাধীদের ভয় না পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Smaller in size, larger in intent

Finance Adviser Salehuddin Ahmed has offered both empathy and arithmetic in his budget speech, laying out a vision that puts people, not just projects, at the heart of economic policy.

10h ago