ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ বিষয়ে জানেন কি
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ বাংলাদেশে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধ এবং এর সমাধানের জন্য প্রণীত একটি আইন। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো ভূমি নিয়ে বিরাজমান বিভিন্ন অপরাধ যেমন অবৈধ দখল, জালিয়াতি এবং অন্যান্য অসদুপায় ব্যবহার রোধ করা এবং এ ধরনের অপরাধের সুষ্ঠু প্রতিকার নিশ্চিত করা।
এতদিন ভূমি সংক্রান্ত সব অপরাধ বিষয়ক মামলা দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারার অধীনে দায়ের করা হতো। বিশেষ করে দণ্ডবিধির ধারা ৪০৬, ৪২০, ৩৮৯, ৪৪৭, ৪৬৭, ৪৭১ ভূমি বিষয়ক অপরাধ নিয়ে আলোচনা ও সাজা বিষয়ে আলোকপাত করেছে।
ভূমি বিষয়ক নতুন এই ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এ ভূমি সংক্রান্ত অপরাধগুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং পাশাপাশি দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার অনেকাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই আইনে মোট ২৭টি ধারা যোগ করা হয়েছে, যেখানে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ সঙ্গায়িত করার পাশাপাশি শাস্তির বিধান সুস্পষ্ট করা হয়েছে। আইনজ্ঞরা মনে করছেন, এই আইন ভূমি ব্যবস্থাপনায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছে।
১৯ ধারায় এই আইনের সব প্রকার অপরাধকে আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন চাইলেই বিচারপ্রার্থীরা ভূমি অপরাধ সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে এই আইনের অধীনে স্থানীয় এখতিয়ারভুক্ত থানাতেই মামলা দায়ের করতে পারবেন এবং সেক্ষেত্রে ওই থানার পুলিশ বিনা পরোয়ানায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারবে।
কী আছে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ এ
এই আইনে অন্যের জমিকে নিজের বলা, ভূমি বিষয়ক তথ্য গোপন করা, মিথ্যা বিবরণ থাকা দলিলে সই করা, অন্যের জমির জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়েও তা হস্তান্তর করা এবং মিথ্যা পরিচয়ের মাধ্যমে অন্যের জমি হস্তান্তরকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেক্ষেত্রে এমন অপরাধের জন্য অপরাধীকে এই আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী অনধিক ৭ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড প্রদান করা হতে পারে।
এই আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ মিথ্যা দলিল বা দলিলের অংশ বিশেষ তৈরি করেন অথবা কোনো দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর তার কোনো অংশ পরিবর্তন করেন অথবা অসাধুভাবে কোনো দলিলে সই, সিলমোহর বা পরিবর্তনে বাধ্য করেন তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি অনধিক ৭ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড।
কেউ যদি কেনা জমির সম্পূর্ণ মূল্য বুঝে পাওয়া সত্ত্বেও ক্রেতা বরাবর জমি হস্তান্তর না করেন, তবে তাকে এই আইনের ধারা ৯ অনুসারে ২ বছরের কারাদণ্ডে ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এ অবৈধ দখলদারদের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কেউ যদি আইনানুগভাবে কোনো জমির মালিক না হয়েও জমি জোর করে দখলে রাখেন, তবে এই অবৈধ দখলের জন্য তাকে এই আইনের ধারা ৭ অনুযায়ী শাস্তি হিসেবে অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে। এ ছাড়া এই আইনের ধারা ১১ ও ১২ অনুযায়ী সরকারি, আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা জনসাধারণের ব্যবহার্য ভূমির অবৈধ দখল, প্রবেশ, কোনো কাঠামোর ক্ষতিসাধন ও সরকারি, আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা জনসাধারণের ব্যবহার্য ভূমির অবৈধ ভরাট, শ্রেণি পরিবর্তনের শাস্তি অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩-এর ধারা ১৬ তে এই আইনের অধীনে অপরাধ সংঘটনে সহায়তাকেও শাস্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে অপরাধ সংঘটনে সহায়তা বা প্ররোচনা প্রদানকারী অপরাধীর সমান শাস্তিপ্রাপ্ত হতে পারেন।
ভূমি সংক্রান্ত প্রতারণা ও জালিয়াতির অপরাধের বিচার ভার শুধু জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর ন্যাস্ত করা হয়েছে। ধারা ১৫ ও ২২ অনুসারে, ভূমির দখল উদ্ধারের ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ কেউ অমান্য করলে তার বিচার ভারও থাকবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপর। এই আইনে প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি দলিল বাতিলের মামলায় ওই দলিল প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি হয়েছে প্রমাণিত হলে আদালত জেলা প্রশাসককে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্টার অফিসে নোট দেওয়ার আদেশ প্রদান করবেন। এখন থেকে ফৌজদারি আদালতের মাধ্যমেই দলিল বাতিল সম্পর্কিত যাবতীয় প্রতিকার পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এই আইনের ধারা ৮(৭) অনুযায়ী, ভূমির দখল উদ্ধারের জন্য দেওয়ানি আদালতে কোনো পক্ষের আবেদনে বা আদালত স্বেচ্ছায় বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোনো জমির দখল উদ্ধারের দায়িত্ব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দিতে পারবেন।
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী জমি দখলে রাখতে পারবেন –
ক) সবশেষ হালনাগাদকৃত খতিয়ানের মালিক
খ) সবশেষ হালনাগাদকৃত খতিয়ানের মালিকের উত্তরাধিকার বা মালিক থেকে অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি
গ) আইন অনুযায়ী সম্পাদিত দলিলের মাধ্যমে অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি
ঘ) আদালতের আদেশে মালিকানা ও দখল অধিকারপ্রাপ্ত ব্যাক্তি।
তবে যদি একই জমির উপর একাধিক দলিল বা জমির দাবিদার থাকে সেক্ষেত্রে কার বা কোন দলিলের প্রাধান্য থাকবে সে ব্যাপারে এই আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।
এ ছাড়া এই আইনের ২০ ও ২১ ধারার অধীনে মামলার সাক্ষীর সুরক্ষায় ও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে।
লেখক: শিক্ষক, আইন ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি))
Comments