নভেম্বরের জাদু, আচারের বয়াম আর একরাশ স্মৃতি

জলাপাইয়ের আচার
ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাইদ

নভেম্বর মাসে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের দিকের আবহাওয়ার কথা আগেভাগে কিছু বলা যায় না। এ সময়ের আবহাওয়া তার নিজস্ব গতিতেই চলে। উপকূলে তৈরি হওয়া ঝড় থেকে শুরু করে দমকা হাওয়া, রোদে ঝলসে যাওয়ার মতো দিন আবার কখনো বা শিশিরভেজা সন্ধ্যা কিংবা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর- এই মাসে ঢাকা শহরের আবহাওয়ার কথা আর না-ই বা বললাম।

এ সময় কখনো এসি অন করার প্রয়োজন পড়ে, আবার কখনো ভারী কম্বলের দরকার হয়। নভেম্বর মাসের একেকদিনের আবহাওয়াকে মাঝে মাঝে মনে হয় যেন একটি পাজলের অনেকগুলো টুকরো! তবে আপনি যেভাবেই বিষয়টি দেখেন না কেন, নভেম্বরের বিকেলগুলো একরাশ স্মৃতি আর রোমান্সের কথা মনে করিয়ে দেয়। আর আমার জন্য এই বিকেলগুলো ভুলে যাওয়া জাদুমন্ত্রের মত স্বপ্নময়।

নভেম্বর
 

নভেম্বর মাস দেশি জলপাইয়ের সময়। আমাদের এই দেশি জলপাই কিছুটা ভিন্ন ধরনের হয়। এর মধ্যে থাকে বড় আকারের একটি বীজ এবং চারপাশে টক স্বাদের এই জনপ্রিয় ফলের অংশ। আর এই অঞ্চলের বিখ্যাত এবং মজাদার আচার কিন্তু এই জলপাই দিয়েই তৈরি হয়।

সরিষার তেলে ডুবিয়ে রাখা সেই অপূর্ব আচারের স্বাদ আমার ছোটবেলার একটি প্রিয় স্মৃতি। আমার নানি যখন বিকালের ঘুমের প্রস্তুতি নিতেন, তখন আমার এবং কাজিনদের কাজ হতো পা টিপে টিপে আমাদের খোলা ছাদে চলে যাওয়া। সেখানে গিয়েই শুকানোর জন্য রোদে মেলে দেওয়া অমৃতের মত আচারের স্বাদ নিতাম আমরা।

প্রথমেই জলপাইগুলো খুব ভালো করে ধুয়ে, মলমলের কাপড় দিয়ে মুছে শুকিয়ে নিতেন আমার নানি। তারপর আলতোভাবে এর মধ্যে সরিষা আর মরিচ মাখিয়ে নকশা করা টিনের প্লেটে (গ্রামাঞ্চলে চেনি বলে পরিচিত) বিছিয়ে দিতেন। লেইস বা কুরুশকাঁটার ঢাকনা দিয়ে ভীষণ যত্নে মোড়ানো থাকতো এই দুই থেকে তিন কেজি আচার ভর্তি প্লেটগুলো।

একইসঙ্গে তিনি বড় এক বয়াম ভর্তি করে সরিষার তেল রোদে দিয়ে রাখতেন। তার রেসিপির বিশেষত্ব ছিল তেলের মধ্যে জলপাই দেওয়ার আগে কয়েকদিন কড়া রোদে এগুলো শুকানো। নভেম্বরের দুপুরের কড়া রোদে তেল হালকা গরম হয়ে আচারের লোভনীয় সুবাস চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত। এ সময় আমাদের আর আটকায় কে!

আচারে ফাঙ্গাস পড়ে সব আচার নষ্ট হয়ে যাবে- এই একটা ভয় ছিল আমার নানির মনে। কাক ও পাখিদের তাড়াতে আর বদনজর এড়াতে তিনি একটি কালো কাকতাড়ুয়া রাখতেন। এত সতর্কতা সত্ত্বেও আমাদের কীভাবে তাড়াবেন সেই সাধ্যি ছিল না তার। নানির ছিল ১৮ জন ছেলেমেয়ে। তাই প্রতি বছর ১৮ বোতল আচার বানিয়ে তাদের কাছে পাঠাতেন তিনি। আর বাকিটা রাখতেন নিজের কাছে। পুরোনো পল্টনের দোতলা বাড়িতে দুপুরের খাবারে আয়োজনে নাতি-নাতনিদের জন্য খিচুড়ি, বেগুন ভাজি আর গরুর মাংসের সঙ্গে পরিবেশন করা হতো সেই আচার।

নানির খোলা ছাদে শুকানো হতো লবণ দেওয়া গরুর মাংস, বানানো হতো গরুর মাংসের শুঁটকি। তার গাছের গোলাপের সুগন্ধ, বাতাসে উড়তে থাকা তার মাড় দেওয়া সাদা শাড়ি, ভেসে আসা আচারের সুবাস, আমাদের চুলে তেল লাগানো- এসব মুহূর্ত আদর, যত্ন আর ভালোবাসায় মোড়ানো আমাদের হারানো দিনের স্মৃতি। বিভিন্ন ঋতু, ফুল, রেসিপি, অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি, স্মৃতি- ধরা ছোঁয়ার বাইরের এই মুহূর্ত ও অনুভূতিগুলোই এই শহরে আমাদের পুরোনো দিনের গল্প তৈরি করে।

পুরোনো দিনের আচার বানানোর এই ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ হচ্ছে, আমি আমার নানির রেসিপি দিয়ে আচার বানানোর চেষ্টা করছিলাম। কাকতালীয়ভাবে তখন আমার কাজিন আমাকে এক বোতল আচার পাঠিয়ে দেয়। এই মৌসুমে আচার বানানোর ঐতিহ্য ষাট, সত্তর এবং আশির দশকেও দেখা যেতো। আম, টমেটো, চালতা, আমড়া - রোদে শুকিয়ে এসব দিয়ে আচার বানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভিটামিন ডির চাহিদা পূরণ হতো রোদে গিয়ে।

বর্তমানে ঢাকা কসমোপলিট্রন ঢাকায় পরিণত হয়েছে। এখানে আমাদের বাচ্চাদের জন্য নতুন নতুন গল্প তৈরি হচ্ছে এবং তারা তাদের এই স্মৃতিগুলোই মনে রাখবে সারাজীবন। যদিও আমি ঠিক নিশ্চিত নই আমি আমার বাচ্চা বা নাতি-নাতনিদের জন্য এর অর্ধেক স্মৃতিও তৈরি করতে পারব কী না। তবে আমরা বাজার থেকে তাজা জলপাই কিনে ঘরে বসে এই মজাদার আচার বানানোর চেষ্টা করে দেখতেই পারি!

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English

Depositors leave troubled banks for stronger rivals

Depositors, in times of financial uncertainty, usually move their money away from troubled banks to institutions with stronger balance sheets. That is exactly what unfolded in 2024, when 11 banks collectively lost Tk 23,700 crore in deposits.

10h ago