কোলাহলের শহরে এক বায়োস্কোপওয়ালার গল্প

বায়োস্কোপ

ঢাকার সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল আর আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেলের এলাকার নাম হিসেবে প্রথমেই আসবে ধানমন্ডির নাম। অবশ্য অভিজাত ক্যাফে, বুটিক হাউজ, অত্যাধুনিক সিনেপ্লেক্স আর নতুন নতুন সুউচ্চ ভবনের ভেতর, আজকাল মাঝে মাঝেই যেন হারিয়ে যায় ধানমন্ডি।

ঠিক এমন সময়ে, সেই ধানমন্ডিতে দাঁড়িয়ে বায়োস্কোপের মাধ্যমে পুরোনো দিনের নতুন গল্প বোনেন মোহাম্মদ হিরু।

কাজের প্রয়োজনে প্রায়ই ধানমন্ডির লেকের ধারের পথ দিয়ে যাই আমি। একেক দিন একেক স্থানে মোহাম্মদ হিরুকে দেখতে পাই তার বিশেষ লাল রঙের বাক্সের সঙ্গে। একটি অদ্ভুত, হাতে তৈরি ফিল্ম প্রজেক্টর মেশিন, যা আদতে দৃশ্যমান বিনোদনের বিকাশের একদম শুরুর দিকের আবিষ্কার।

তবে যতবারই দেখি না কেন, পরের বার ঠিকই তাকে চিনতে ভুল হয় আমার। কারণ একদিন তাকে পাই লেকের ধারে পরিচিত মুখ হিসেবে, তো পরদিনই তিনি পুরোপুরি বদলে যান জোকারের পোশাকের আড়ালে। ব্যস্ত থাকেন কৌতূহলী দর্শকের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে।

মনে হয় যেন এক অন্য মানুষ, যিনি বায়োস্কোপের দৃশ্যের সঙ্গে প্রতিদিন বদলান। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? তাই সেই প্রশ্ন নিয়েই হাজির হই মোহাম্মদ হিরুর কাছে।

জানা গেল, সবই আবহাওয়ার খেলা। মানে ঠান্ডার দিনে বা শীতকালে রঙচঙে পোশাক পরে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু গরম পড়তে শুরু করলেই হিরুও সাধারণ পোশাকে ফিরে আসেন। একটা হাসি ছুড়ে দিয়ে বললেন, 'ওই পোশাকটা পরলে খুব গরম লাগে।'

একেক বার তাকে একেক পোশাকে দেখার রহস্যটা এবার বুঝলাম। আসলেই, কয়েক পরতের রঙচঙে ওই পোশাক পরে ভিড়ের মধ্যে দর্শককে আনন্দ দেওয়া সহজ কাজ নয়।

বায়োস্কোপের প্রতি তার আগ্রহ আর ভালোবাসা দেখে প্রশ্ন করি, কেন তিনি পেশা হিসেবে বায়োস্কোপ দেখানোকে বেছে নিলেন।

হিরু বলেন, 'আমি দেশের উত্তরের জেলা বগুড়ায় বড় হয়েছি। আমার শৈশবের সবচেয়ে প্রাণবন্ত স্মৃতিগুলো হলো গ্রামের মেলার। যেখানে বায়োস্কোপ দেখানো হতো, রাতে আলোকসজ্জা হতো। তখনই আমি বায়োস্কোপ আর এই জাদুর বাক্স নিয়ে গল্প বলে যাওয়ার পেশার প্রেমে পড়ি।'

'বায়োস্কোপের বাক্সটি আমি নিজে তৈরি করেছি। কোনো সহায়তা বা পরামর্শ ছাড়াই আমি এটা তৈরি করি। প্রথমদিন যখন বায়োস্কোপ দেখেছিলাম, সেদিন থেকেই জানতাম; কোনো না কোনোদিন আমি এটা তৈরি করব। আর এখন আমি সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েই বেঁচে আছি।'

কিন্তু নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটলে কখনো কখনো বিড়ম্বনার মধ্যেও পড়তে হয়, যোগ করলেন হিরু।

তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো, এ ধরনের শিল্পের সঙ্গে পথ চললে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপার্জন করা সম্ভব না। আমি প্রতিদিন আর্থিক দিক থেকে সংগ্রাম করি।'

'সাধারণত প্রতিদিন বিকাল ৫টার পরে আমি এখানে দাঁড়াই। গ্রাহকদের মোটামুটি ভিড়ও থাকে। কিন্তু কোনো কারণে আবহাওয়া খারাপ থাকলে, একজন দর্শকও পাওয়া যায় না', যোগ করেন তিনি।

এতসব কথা বলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন মোহাম্মদ হিরু।

এরপর বলেন, 'খরচ মেটাতে আমি কিছু সাজসজ্জার কাজও করি। মূলত ছোট অনুষ্ঠানগুলোয় কাজ করি। ইদানিং অনেকে আমাকে শিশুদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য নিয়ে যান।'

'কিন্তু ঢাকার মতো শহরে বাড়তি এই কাজ করেও আর্থিক স্থিতিশীলতা পাওয়া কঠিন। আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা এখানে থাকবেই। তারপরেও এই শিল্পের প্রতি আবেগ আর ভালোবাসার কারণেই এখনো টিকে আছি।'

আসন্ন শীত মৌসুমের কথা মনে হতেই মোহাম্মদ হিরুর দুচোখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

তিনি বলেন, শীতকালে দর্শক পাওয়া যায়। তখন নানা ধরনের উৎসব হয়। শিশুরা সারি বেধে আমার বায়োস্কোপের সামনে আসছে, তাদের চোখভর্তি উত্তেজনা, তাদের খুশি আমাকে আনন্দিত করে। তাদের উচ্ছ্বাস মনে করিয়ে দেয়, কেন আমি কাজটি করে যাচ্ছি।

শত সংকটের পরেও বায়োস্কোপের প্রতি মোহাম্মদ হিরুর আবেগ আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়ে যায়। ধানমন্ডির সব আধুনিকতার মাঝে এক টুকরো ঐতিহ্য হয়ে বায়োস্কোপের বাক্স নিয়ে হিরুর দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে আমার ভালো লাগে।

এমনকি প্রচণ্ড গরমে রঙিন পোশাকের নিচে দরদর করে ঘামতে ঘামতে ওই পোশাক পরিত্যাগ করলেও হিরু তার আবেগ কিংবা ভালোবাসা ত্যাগ করেন না। সেইসব দিনগুলোয় আপনি তাকে পাবেন সাধারণ পোশাকে, হয়তো মাথায় একটি টুপি পরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন ধানমন্ডি লেকের ধারে। হয়তো চোখ ধাঁধানো পোশাকে নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে বায়োস্কোপের জন্য বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে।

মোহাম্মদ হিরু সাধারণত প্রতিদিন বিকাল ৫টায় ধানমন্ডির ৬/এ সাত মসজিদ রোডের আনাম র‌্যাঙগস প্লাজার সামনে দাঁড়ান।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English
explanations sought from banks for unusual USD rates

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago