বিড়াল না কিনে অ্যাডপ্ট করুন

বিড়াল
ছবি: অর্কিড চাকমা

কিছু কিছু ভালোবাসার সম্পর্ক এমনই তীব্র যে তা ভাষা কিংবা বোঝাপড়ার দেয়াল ভেঙে এগিয়ে যায়। শুনতে অনেকটা কল্পনাঘেঁষা মনে হলেও আমাদের চারপাশের চারপেয়ে ছোট্ট বন্ধুদের সঙ্গে কিন্তু এমন বন্ধুত্ব খুবই সহজ। পোষা প্রাণী অ্যাডপ্ট করার জন্য ফেসবুকে আছে বহু গ্রুপ ও প্ল্যাটফর্ম। আর এ থেকেই বোঝা যায়, ঢাকা শহরে শুধু জনসংখ্যাই নয়, পোষা প্রাণীর সংখ্যাও বেড়েছে।

রাস্তায় ঘুরতে থাকা কুকুর-বিড়ালদের জীবন খুব কষ্টের। নিত্যদিনের লাথিঝাঁটা খেতে খেতে তাদের কাছে মানুষের নিষ্ঠুর স্বভাবটাই যেন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে অপুষ্টি ও ক্ষুধার দুর্ভোগ তো আছেই। তাই এদের মধ্যে একটি প্রাণীকেও কেউ যদি নিজের ঘরে তুলে নেন, তবে স্বাভাবিকের চেয়ে ক্ষণস্থায়ী জীবন আর ভোগান্তির মৃত্যু, দুই থেকেই বাঁচানো সম্ভব। এমন একটি শহর, যেখানে রাস্তাঘাটে থাকা প্রাণীরা সারাক্ষণই খাবার আর নিরাপত্তার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচছে, সেখানে অ্যাডপশন অনেক বড় একটি সমাধান। আর এতে করে তাদের জীবনটা যেমন বেঁচে যাবে, তেমনি আমরাও পাব আজীবনের বিশ্বস্ত বন্ধু। কিন্তু এরপরও এমন অনেক পরিবারই আছে, যাদের মধ্যে অ্যাডপশনের চাইতে দোকান থেকে পশুপাখি কেনার দিকে ঝোঁক বেশি দেখা যায়। আর এতে করে পুরোনো সমস্যার সমাধান তো হয়ই না, বরং তৈরি হয় আরও একটি সম্পূর্ণ নতুন সমস্যা।

দোকান থেকে পশুপাখি কেনার পেছনের মনোভাবটা মূলত আসে নান্দনিকতার বাসনা থেকে। অনেকেরই এমন বিশ্বাস রয়েছে যে বিদেশি ব্রিডের পোষা প্রাণী মানেই বেশি সুন্দর। কিন্তু যারা প্রাণীদেরকে ভালোবাসতে চান, তাদের বোধহয় এইটুকু বোঝা বেশি প্রয়োজন যে জ্যান্ত প্রাণীটি কোনো ঘর সাজানোর নির্জীব বস্তু নয় এবং বেশিরভাগ উদ্ধারকৃত পোষা প্রাণীই পর্যাপ্ত যত্ন পেয়ে ভীষণ আদুরে হয়ে ওঠে। বিচিত্র এই জগতে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব। আর তা শুধু সঠিক সঙ্গ ও যত্নের মধ্য দিয়েই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।

আর যদি বা আবেগী দিক থেকে চিন্তা সরিয়ে অর্থনীতির দিকেও নজর দিই, তবে অ্যাডপশনে কোনো ধরনের খরচাই করতে হচ্ছে না। নতুন একটি সদস্যকে বাড়িতে আনতে টাকা গুনতে হচ্ছে না। আর দত্তক নেওয়া এসব প্রাণীর ক্ষেত্রে উঁচু ব্রিডের প্রাণীর মতো পেশাদার দেখভালের দরকার হয় কম। অন্যদিকে যদি পোষা প্রাণীর বাজারে গিয়ে একটি কুকুর বা বেড়াল কিনে আনা হয়, যেমন ধরুন পার্সিয়ান ক্যাট—তবে তাতে এক ধাক্কায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা তো যাবেই, আর দীর্ঘমেয়াদে তার গ্রুমিং ও মেইন্টেইন্যান্সের জন্যও নিয়মিত অনেক টাকা খরচ করতে হবে। এ ছাড়াও তাদের দেখভালে একটু ভুলচুক মানেই অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি। খুব সহজেই এসব প্রাণীর মধ্যে ফাংগাল ইনফেকশনের মতো অসুখ দেখা দেয়।

এ ছাড়া নিজস্ব বিবেকবোধ ও নৈতিকতার দিক দিয়ে তো অ্যাডপশনই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। যারা ব্রিডিং করান, তাদের ব্যবসায়িক নীতি প্রচণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। ব্রিডাররা প্রথমে ছোট ছোট বিড়ালছানা, কুকুরছানা কিনে নিয়ে আসে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদেরকে জোরপূর্বক বিপরীত লিঙ্গের বিড়াল বা কুকুরের সঙ্গে প্রজননে ঠেলে দেওয়া হয়। যত বেশি সম্ভব বংশবিস্তার করানোই এদের মূল উদ্দেশ্য, প্রাণীর সুস্থতা নয়। আর যখনই নতুন ছানাগুলো জন্ম নেয়, তখন মায়ের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটানোর আগেই তাদেরকেও বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর এভাবেই পোষা প্রাণীর বাজারের এই দুষ্টচক্র চলতে থাকে। মা প্রাণী বা নবজাতকদের দিকে কোনো খেয়ালই করা হয় না। ব্রিডিং ইন্ডাস্ট্রিতে এই প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা নতুন কিছু নয়, বরং সবাই তা করে থাকে। তাই যদি আমরা এসব বাজার থেকে পোষা প্রাণী কেনা বন্ধ করে দিই এবং অ্যাডপশনের চেষ্টা করি, তবে প্রাণী নির্যাতনের এই অবিরাম চক্র কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব।

এই শহরে আমরা সবাই থাকি। মানুষ, পশুপাখি। ওরা কথা বলতে পারে না বলে প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হয়—তবু ওদের দিকে একটু আদর নিয়ে তাকালে এর কয়েকগুণ বেশি ফিরিয়ে দেয় ওরা। তাই যদি নিজের বাসায় কোনো প্রাণীকে আমরা সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই, তবে বাজার থেকে কেনার বদলে যারা ইতোমধ্যেই রাস্তাঘাটে খাবার কিংবা থাকার জায়গার অভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নেওয়াই ভালো। পোষা প্রাণীদের প্রতি নিজের সদয় মনোভাব দেখানোর মাধ্যমে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও একই শিক্ষা দিতে পারব, আর এভাবেই পৃথিবী হয়ে উঠবে আরও সুন্দর, বৈচিত্র্যময়।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments

The Daily Star  | English

Netanyahu says Israel close to meeting its goals in Iran

JD Vance says US at war with Iran's nuclear programme, not Iran

17h ago