ইমোজি: আবেগের সহজ প্রকাশ কি কমিয়ে দিচ্ছে যোগাযোগ দক্ষতা?
কোনো সন্দেহ নেই যে, গত কয়েক দশক ধরে ডিজিটাল মিডিয়া আর যোগাযোগ ব্যবস্থায় চলছে ইমোজির আধিপত্য। আমাদের নিউজফিড থেকে শুরু করে কমেন্ট বক্স, মেসেজ থ্রেড এবং যোগাযোগ চালিয়ে নেওয়ার সব জায়গায় দেখা মেলে ইমোজির। কেবল ডিজিটাল মিডিয়াতেই নয়, বাস্তব জীবনেও দেখা পাবেন ইমোজি খেলনা। এমনকি ইমোজি নিয়ে আলাদা সিনেমাও হয়েছে।
মানুষের প্রতিটি আবেগের প্রতিচ্ছবি মেলে ইমোজিতে। আমাদের রোজকার যোগাযোগে ইমোজি যুক্ত করে নতুন ব্যক্তিত্ব আর রসবোধ। ইমোজির ব্যবহার সাধারণত হয় হালকা মেজাজের। কিন্তু এর অতি ব্যবহার আমাদের সামনে নতুন প্রশ্ন হাজির করছে। আর সেটা হলো, ইমোজি ব্যবহারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের পথ বদলে যাচ্ছি কি না! আবার আমরা কি এমন একটি জগতের দিকে যাচ্ছি যেখানে শব্দ ইমোজি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছে?
ইমোজি প্রথম দৃশ্যপটে আসে ১৯৯০ দশকের শেষভাগে জাপানের ইন্টারফেস ডিজাইনার শিগেতাকা কুরিতার হাত ধরে। তখন থেকেই বিশ্বজুড়ে ভাইরাল হয় ইমোজি ব্যবহারের ট্রেন্ড। বয়স, সংস্কৃতি ও ভাষা নির্বিশেষে বিশ্ববাসীর সর্বজনীন ভাষায় পরিণত হয় ইমোজি। মানুষ যে আবেগই প্রকাশ করার চেষ্টা করুক না কেন, তার সব আছে ইমোজির ভাণ্ডারে। সেটা হতে পারে আনন্দ, উত্তেজনা কিংবা ভয়ের অনুভূতি। ইমোজি দিয়ে এর সবকিছুই বোঝানো সম্ভব। শুধু তাই নয়, এটি যোগাযোগকে আরও দ্রুত করেছে এবং সব ধরনের মানুষের জন্য অনুভূতিকে করেছে বোধগম্যও।
এখন বলব ইমোজি ব্যবহারের কিছু নেতিবাচক দিক সম্পর্কে। এটা ঠিক যে, বছরের পর বছর ধরে ইমোজি ব্যবহার করে আমরা অনুভূতি প্রকাশ করছি। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও ঠিক যে, হালকা চালের ইমোজি ব্যবহার করতে গিয়ে হয়ত আমরা আবেগের প্রকৃত গভীরতা হারাচ্ছি। কারও সঙ্গে যোগাযোগের সময় চিন্তা-ভাবনা করে কিছু লেখার বদলে কয়েকটি ইমোজিতে ক্লিক করেই আমরা কাজ সারছি। এক্ষেত্রে ইমোজির একটি ভালো তুলনা হতে পারে, ফাস্টফুডের সঙ্গে। যা দ্রুত ও সুবিধাজনক উপায়ে খাওয়া যায়, কিন্তু আদতে স্বাস্থ্যকর নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার সোশ্যাল মিডিয়া কনসালটেন্ট এরিক হ্যানসন মূলত মাঝারি ও বড় কোম্পানিগুলোর জন্য কাজ করেন। বিপণন ও যোগাযোগে তার অভিজ্ঞতা ২৫ বছরেরও বেশি সময়ের।
ইমোজি নিয়ে তৈরি হওয়া উদ্বেগের বিষয়ে তিনি বললেন, 'ভিজ্যুয়ালি ভাবতে শেখা চমৎকার বিষয়। আমি তা নিয়ে বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু নিজের চিন্তাভাবনা লিখে প্রকাশ করার দক্ষতা একেবারে ভিন্ন বিষয়। আমার অভিজ্ঞতায়, জনসংযোগ বা যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদেরকেই ভালো করতে দেখি যাদের লেখার হাত শক্তিশালী, ডিজাইন বা ভিজ্যুয়ালের নয়।'
পেশাজীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইমোজির মতো সহজে ব্যবহার্য সংকেতের বহুল ব্যবহারের কারণে অনেক মানুষেরই মানসিক উদ্দীপনা বা প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে। ধরুন, যখন আমরা হাসির ইমোজিতে ক্লিক করি, তখন বাস্তবে কতজনই বা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ি?
বিশেষ করে, শিশুদের ক্ষেত্রে প্রভাবটি বেশ ব্যাপক। কারণ এ ধরনের যোগাযোগ পদ্ধতি ব্যবহার করার কারণে তাদের লিখিত যোগাযোগ দক্ষতার সঠিক বিকাশ ঘটে না।
হ্যানসন বলেন, 'এরই মধ্যে দেখা গেছে যে শিশুরা স্কুলে সুসংসত, কার্যকর ও সৃজনশীল লেখা শিখতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। এই শিশুরা এখন যোগাযোগই কম করে, সেখানে লিখিতভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশের পরিমাণ তো একেবারেই কম। যেটুকু অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তার বড় অংশই ইমোজি বা ভিজ্যুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে।'
অনেক সময় অনুবাদ করতে গেলে ইমোজির অর্থও বদলে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, থাম্বস আপ ইমোজির অর্থ ভালো কিছুকে সমর্থন করা হতে পারে। আবার সঠিক প্রসঙ্গ ছাড়া ব্যবহার করা হলে তা ব্যাঙ্গাত্মকও হয়ে উঠতে পারে। অর্থ বুঝে ইমোজি ব্যবহারের মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ্ম রেখা আছে, যা মাথায় রেখে প্রতিবার ইমোজি ব্যবহার বেশ ক্লান্তিকর হতে পারে। সে কারণেই বেশিরভাগ মানুষ এই সংবেদনশীলতাকে অবহেলাও করে যায়।
ইমোজির ব্যবহারকে এতটাই সাধারণীকরণ করা হয়েছে যে, আপনি যদি ইমোজি ব্যবহার না করেন তাহলে অনেক মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা আপনাকে রোবট ভাববে!
তরুণ প্রজন্মের কাছে ইমোজি প্রকৃতির মতোই স্বাভাবিক, কিন্তু অন্য অনেকের কাছে এর অর্থ ধাঁধার মতো। অনেক সময় ইমোজির ব্যবহার গভীর ও অর্থপূর্ণ আবেগের বহিঃপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ আপনার হয়ে ইমোজিই সেই আবেগ প্রকাশ করে দিচ্ছে।
একটি বিশ্বের কথা চিন্তা করুন, যেখানে মানুষের জটিল সব আবেগকে প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কয়েকটি মাত্র ছবি। এটা হয়ত খুবই দক্ষতার পরিচায়ক, কিন্তু সেইসঙ্গে আমরা যা হারাচ্ছি, তার চেয়ে কি মূল্যবান?
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments