ঢাকায় বিয়ের শাড়ি-লেহেঙ্গা পাবেন কোথায়

ছবি: সংগৃহীত

বিয়ে মানেই একজন নারীর অনন্যা হয়ে ওঠার সাতকাহন। অলঙ্কার ও বস্ত্রের আভরণ অন্দরমহলের দেবীকে যেন উজাড় করে তুলে ধরে সুন্দরের পূজারিদের সামনে।

বাংলা ভূ-খণ্ডের কারিগররা যুগ যুগ ধরে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়িকে। সময়ের বিবর্তনে বিশ্বায়নের প্রভাবে এখন বউ সাজে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বিগত তিন দশকে শুধুমাত্র এই বিয়ের সজ্জাকে ঘিরেই অনেকটা সমৃদ্ধ হয়েছে পোশাক শিল্প। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাল ফ্যাশনে ভর করে ব্র্যান্ডে রূপ নিয়েছে বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলুন দেখে নেওয়া যাক বিয়ের শাড়ি ও লেহেঙ্গার জন্য ঢাকার সেরা কয়েকটি মার্কেট ও ব্র্যান্ড।

মিরপুর বেনারসি পল্লী

শাড়ি শব্দটির সঙ্গে সবচেয়ে পরিচিত বিশেষণটি হলো বেনারসি। আর ঢাকার মিরপুরস্থ বেনারসি পল্লীর ঠিকানা আলাদা করে মনে রাখা দরকার হয় না। বহু বছর ধরে অনেকটা পরিপূরক শব্দের মতোই যেন লেগে আছে ঢাকাবাসীর মুখে।

মিরপুর ১০ এ অবস্থিত এই মার্কেটের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৯৫ সাল। বেনারসির পাশাপাশি এখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাতান ও সিল্ক। এখানে সব মিলিয়ে শাড়ির দোকানের সংখ্যা প্রায় ২০০টি।

অন্যান্য শাড়ির মধ্যে আছে ঢাকাই মসলিন, জামদানি, টাঙ্গাইল তাঁত, রাজশাহী সিল্ক, টাঙ্গাইল হাফ সিল্ক, কাটা শাড়ি, ও জর্জেট। প্রতিটি শাড়িতেই রয়েছে আভিজাত্যের ছোঁয়া। পরিণত রং, হাল্কা ওজন, আর ন্যায্য দামের কারণে উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত সবারই ভীড় হয় এখানে। বধূ সাজসজ্জায় শাড়ির জন্য প্রথম পছন্দ মিরপুরের এই বেনারসি পল্লী।

ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট

মধ্যবিত্ত রাজধানীবাসীর সাধ্যের মধ্যে উপযুক্ত গন্তব্য হচ্ছে ধানমন্ডির হকার্স মার্কেট। গাউছিয়া মার্কেটের উল্টো পাশে অবস্থিত এই মার্কেটে প্রচুর দোকান থাকায় একসঙ্গে অনেক সংগ্রহ থেকে পছন্দ করা যায়।

ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল ও জামদানি শাড়ির প্রসিদ্ধ দোকান তো আছেই। সেইসঙ্গে মসলিন, নেটশাড়ি, পার্টি শাড়ি, অলগেঞ্জ, পার্টি লেহেঙ্গা, ফ্লোরাল প্রিন্ট ও টিস্যুসহ বাহারি রকমের শাড়ি আকৃষ্ট করে ক্রেতাদের। কাতানের মধ্যে রয়েছে মন্থানের কাতান, বেনারসি কাতান, ভেলোর কাতান, ও বেলগা কাতান।

নিউ মার্কেট

কেনাকাটা যখন বিয়ের জন্য তখন নিউ মার্কেটে অবশ্যই একবার ঘুরে আসা উচিত। আজিমপুরের উত্তরাংশের এই বিশাল মার্কেটটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে।

সেই শুরু থেকেই সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের সংগ্রহ থাকার কারণে সবার কাছে এক নামে পরিচিত এই পুরনো মার্কেটটি। আর তাই শুধু শাড়ির জন্যই নয়, বিয়েতে দরকারি যাবতীয় জিনিসপত্রের জন্যও আসতে হবে এখানে।

এখানে কেনাকাটায় সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে সাশ্রয়ী মূল্য এবং স্বাধীনভাবে দর কষাকষির সুযোগ। বড় বড় শপিং মলের হাজার টাকার পণ্যও মাত্র কয়েকশো টাকাতেই কেনা সম্ভব এখান থেকে। এছাড়া এখানকার বেশ কিছু ব্যবসায়ী অনেক বছর ধরে কাপড় বিক্রি করে আসছেন। ফলশ্রুতিতে, এখানে দীর্ঘ মেয়াদী ক্রেতা-বিক্রেতা সুসম্পর্ক দেখা যায়।

বেইলি রোড

দীর্ঘ ২৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে গড়ে উঠা শতাধিক শাড়ির দোকান বেইলি রোডকে শাড়ির বিশাল বাজারে পরিণত করেছে। এখানে পরিধেয় যেমন বাহারি, দামটাও তেমন মেলানো মেশানো।

বেইলি রোডের আশপাশসহ দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ক্রেতারা আসেন প্রধানত টাঙ্গাইলের তাঁত ও ঢাকাই জামদানির টানে। তবে মিরপুর, কুমিল্লা, ডেমরা, সিরাজগঞ্জ, ও পাবনাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তাঁতের শাড়িও এখানে পাওয়া যায়।

এ ছাড়া দোকানগুলোতে মসলিন, রাজশাহী সিল্ক, টাঙ্গাইলের সিল্ক, মিরপুরের কাতান, পাবনার কাতানের চাহিদাও আছে। জামদানি, বালুচুরি, সুতি, জুট কটন, জুট কাতান এবং হাফ সিল্কও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।

বিদেশি শাড়ির মধ্যে দেখা যায় কাঞ্জিভরম, পঞ্চমকলি, শিফন, ক্র্যাফট, জর্জেট, অপেরা কাতান, কাঁঠাল কাতান, আলাপ কাতান, খাদি কাতান, ভোমকা কাতান। হাতের কাজ করা এবং ভেজিটেবল ডাই করা শাড়িও পাওয়া যায় এখানে।

জ্যোতি

১৯৯০ সাল থেকে শুরু হওয়া জ্যোতি মূলত রেডিমেড পরিধান বিক্রি করে থাকে। প্রথমে ভারতীয় শাড়ি, কামিজ এবং বধূ সজ্জার সরঞ্জাম নিয়ে নূর ম্যানশন শোরুমের মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে তারা তাদের বিয়ের সাজসজ্জায় দোপাট্টা যুক্ত করে।

তাদের বিশেষ পণ্যগুলো হলো বিয়ের শাড়ি, লেহেঙ্গা, এবং প্রসাধনী। ঢাকা শহর জুড়ে জ্যোতির মোট ১১টি শাখা রয়েছে।

আনজারা

২০১৪ সালে একটি অনলাইন শপ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় আনজারার। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নওরীন ইমান ইরা এবং আবিরুল ইসলাম চৌধুরী। খুব ছোট থেকে ইরার ডিজাইনার হতে চাওয়ার স্বপ্নের ফসল এই আনজারা। আবির সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠানটির অর্থায়ন এবং বিপণনের কাজটি দেখাশোনা করেছেন।

তাদের দক্ষতার জায়গা হচ্ছে লেহেঙ্গা, গাউন, শারারা, এবং ঘারারাসহ বিভিন্ন ধরনের বধূর পোশাকে।

আনজারা এখন কেবল ইন্টারনেটেই সীমাবদ্ধ নেই। তাদের এখন ঢাকায় তিনটি শাখা, যার প্রত্যেকটিরই রয়েছে ভিন্ন শৈলীর পোশাক। প্রধান শাখাটি থেকেই মূলত বিয়ের পোশাক বিক্রি করা হয়। আর অন্য দুটিতে তোলা হয়েছে বিভিন্ন পার্টিতে পরিধানের পোশাক।

সাফিয়া

'সাফিয়া' বিয়েতে মেয়েদের পরিধানের জন্য একটি বিশ্বস্ত ফ্যাশন হাউসের নাম। এটি তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন সাফিয়া সাথী।

তিনি সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে 'শং' নামে একটি অনলাইন শপ দিয়ে তার ডিজাইনের কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি তার নিজস্ব ডিজাইনের তৈরি সালোয়ার কামিজ এবং কুর্তি বিক্রি করতেন।

২০১৬ সালে তিনি 'এ হ্যাপি ইভেন্ট বাই সাফিয়া' নামে বিয়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৭ সালে 'সাফিয়া' গঠনের মাধ্যমে তার স্বপ্নটি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে শুরু করে।

সাফিয়ার বর্তমানে ২৫ জন কারিগরের একটি নিবেদিত দল রয়েছে। ব্র্যান্ডের সব ডিজাইন সাথী একাই করেন। তবে সেলাই ও জারদৌসির মতো সার্বিক অলঙ্করণ কাজের জন্য একজন অলঙ্করণ শিল্পী নিযুক্ত রয়েছেন।

সাফিয়ার দুটি স্টুডিওর একটি রামপুরায় এবং অন্যটি বনানীতে। বনানী স্টুডিওটি থেকেই আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করা হয়। আর রামপুরার স্টুডিওটি সমস্ত কারখানার কাজ এবং নমুনা নির্বাচনের জন্য।

নাবিলা'স বুটিক

নাবিলা'স বুটিকের কর্ণধার শামীমা নবী দেশের প্রথম নারী উদ্যোক্তাদের একজন, যিনি তার নিজের গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

১৯৯০ এর দশকে মেয়ে নাবিলা নবীর নামে তিনি চালু করেছিলেন নাবিলা'স বুটিক। এখন মা নিজে ডিজাইনার, আর মেয়ে মার্কেটিংয়ের কাজ দেখছেন।

মায়ের গুণ পুরোটাই পেয়েছেন মেয়ে। তারই বদৌলতে আধুনিক পোশাক নিয়ে তিনি নিজের একটি আলাদা সেকশন চালু করেছেন।

নাবিলা'স বুটিকের বর্তমান স্টোর সংখ্যা মোট ৩টি গুলশান, ধানমন্ডি, ও উত্তরা।

সারাহ করিম কচার

বাংলাদেশের এই বিলাসবহুল ফ্যাশন হাউসের মালিক সারাহ করিম। তিনি নিজেই হাউসের ডিজাইনার। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩৫ বছর পুরোনো। প্রথমে এর নাম ছিল আল এহসান, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সারাহ করিমের নানি-শাশুড়ি। তখন সারাহ শখের বশেই কাজ করতেন।

তারপর আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে তিনি নিজের ব্র্যান্ড দিয়ে নতুন করে কোম্পানির কার্যক্রম শুরু করেন। সারাহ করিম কচারের দক্ষতার জায়গা এমব্রয়ডারি, জারদোসি, আড়ি কাজ এবং গোটাপট্টিতে।

দেশের পুরোনো এই ব্র্যান্ডটির একমাত্র আউটলেট গুলশানে।

সাহার রহমান কচার

এই সমসাময়িক ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তা দুই বোন সাহার রহমান এবং আমানা রহমান। বিগত এক দশকে শাখা মেলে বিকশিত হয়েছে।

সাহার রহমান কচারের শুরুটা হয়েছিল ২০১০ সালে একটি ঘরোয়া প্রদর্শনীর মাধ্যমে যা শুধুমাত্র পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই প্রদর্শনীর সাফল্যের ফসল ২০১১ সালের 'সাহার রহমান ক্লথিং' নামের ফেসবুক পেজটি।

২০১৪ সালে তারা গুলশানে ছোট একটি স্টুডিও চালু করেন। ২০১৯ সালে তা বেশ বৃহৎ আকার ধারণ করে, যেটি গঠিত হয়েছিলো প্রায় ৩ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে।

এই আউটলেটটি ছাড়াও তাদের দুটি উৎপাদন কারখানা রয়েছে। একটি বারিধারা ডিওএইচএস-এ এবং আরেকটি তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায়।

ব্র্যান্ডটির পণ্য বিক্রির কাজ পরিচালিত হয় মূলত চারটি বিভাগে। সেগুলো হলো- বিলাসবহুল প্রিট বা সেলাই করা স্যালোয়ার স্যুট, সান্ধ্যকালীন পোশাক, ভারী ফরমাল পরিধেয়, এবং বিয়ের পোশাক।

পরিশিষ্ট

বিয়ের শাড়ি ও লেহেঙ্গার জন্য ঢাকার এই বিপণীগুলোর মধ্যে নিউমার্কেট ও হকার্স মার্কেট বহু বছর ধরে স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করে আসছে। দামে বেশ তারতম্য থাকলেও এগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে চলছে বেইলি রোডের দোকানগুলো। ঐতিহ্য ও গুণগত মান বিচারে মিরপুর বেনারসি পল্লী সর্বদাই সর্বশ্রেণীর গ্রাহকের মন জয় করে।

একইভাবে নির্দিষ্ট শ্রেণি বিয়ের পোশাকের জন্য বিচ্ছে নিচ্ছেন জ্যোতির মতো রেডিমেড বিয়ের সজ্জার মার্কেটগুলোকে। নকশাকারদের ঘিরে গড়ে উঠা ফ্যাশন হাউসগুলোর মধ্যে সাহার রহমান ও সারাহ করিম কচার সবচেয়ে অভিজাত। অবকাঠামোগত দিক থেকে এদের থেকে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও জনপ্রিয়তায় কোনো ঘাটতি নেই নাবিলা'স বুটিক, আনজারা ও সাফিয়ার।

দেশীয় বাজারে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছে এই ব্র্যান্ডগুলো।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

4h ago