বাঁচার জন্যই দরকার পরিবার, বন্ধুত্ব
ঢাকায় আমাদের ছোট বাসাটিতে যখন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিচিতদের হাট লেগে থাকতো, অনেকের সঙ্গে যখন আমাদের থাকার ঘর-বিছানা- পড়ার টেবিল, মুরগির মাংস, মাছের টুকরো ভাগাভাগি করে খেতে হতো, তখন আমরা মাঝে মধ্যে রাগান্বিত হতাম। আম্মাও বিরক্ত হয়ে বলতেন, 'এত অল্প টাকায় রাবণের পরিবার টানা যাচ্ছে না।'
শুধু আব্বার ভাবের কোনো পরিবর্তন ছিল না। আব্বা বলতেন, 'এই যে এতগুলো মানুষ একসঙ্গে আছো, এও কি কম আনন্দের? আরাম-আয়েশ, পোলাও-কোর্মা খাওয়া বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে মানুষের পাশে থাকা। এই যে তোমাদেরই ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন তোমাদের কাছে থেকে জীবনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, এটাই সুখের।'
'একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, সবার সঙ্গে থাকলে কোনো না-পাওয়া, দুঃখ-কষ্ট তোমাকে সহজে স্পর্শ করবে না। আর তুমি অনুভব করবে যে, তুমি একা নও। দেখবে মানসিকভাবে শক্তি খুঁজে পাবে। সবাই সবার পাশে থাকলে মানুষ কখনো ভেঙে পড়ে না।' বড় হতে হতে আব্বার কথা অক্ষরে অক্ষরে উপলব্ধি করেছি।
আধুনিক মানুষ এখন একা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ যখন ভালো থাকে, সুখে থাকে, সুস্থ থাকে তখন একা থাকাটা এনজয় করে। কিন্তু হতাশা, বিষণ্ণতা, ভয়, সন্দেহ, উদ্বেগ খুব বেড়ে গেলে, জটিল কিছু মানসিক রোগ হলে এবং দুরারোগ্য কোনো ব্যাধি হলে মানুষ তখন একা ও অসহায় বোধ করে। সেই অসহায়ত্বের সময় এবং মানুষের জীবনে হতাশা, ব্যর্থতা ও বিপর্যয় নেমে এলে মানুষ কাউকে পাশে চায়। সে হতে পারে তার পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী কিংবা স্বজন।
মানসিকভাবে শক্ত মানুষ সব বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আবার অনেকেই নিজের বিচ্ছিন্ন অবস্থাকে মেনে নিতে পারে না। মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ পেতে গেলে সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ এবং সুস্থ সমাজ প্রয়োজন। এই একা হয়ে যাওয়া নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে আসে মানুষের। বয়স হয়ে গেলে যেগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে যেতে থাকে।
মানব সমাজের ইতিহাস মানেই সমাজবদ্ধ মানুষের কথা বলে। পরিবার ও সমাজ ছাড়া মানুষ বাঁচে না, বাঁচা কষ্টকর। আমাদের মতো দেশগুলোতে মানুষ এখনো একা থাকাকে ভয় পায় বা এড়িয়ে চলে। বর্তমান শহুরে নিরাপত্তা, নানা প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা মানুষকে একা বাস করার কিছু সুযোগ হয়ত করে দিচ্ছে, কিন্তু মানসিকভাবে মানুষ একা থাকা নিয়ে এখনো দুর্বল। এই কারণেই মানুষ শেষ দিন পর্যন্ত পরিবার, বন্ধু ও সন্তানের পাশে থাকতে চায়।
আমরা সবাই এখন ইঁদুর দৌঁড় প্রতিযোগিতায় আছি। এই প্রতিযোগিতা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের হতাশা ও বিষণ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হতাশা মানুষের সৃজনশীলতা, বোধ ও বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করে দেয়। চাপিয়ে দেওয়া সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে আরও চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এসব কারণেই সমাজে বাড়ছে আত্মহত্যা। সব মানুষের মানসিক ধরণ ও শক্তি এক নয়। সবাই সব আঘাত, প্রবঞ্চনা, লজ্জা, ব্যর্থতা, অশান্তি একভাবে মেনে নিতে পারে না এবং তখনই পালিয়ে যেতে চায়।
আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানুষের মন ও মননে যে আসলে কী ঘটছে, সেটা বাইরে থেকে বুঝতে পারা কঠিন। পাশে থাকা মানুষও অনেক সময় বুঝতে পারে না যে, তার পাশের মানুষটি আত্মহত্যা করতে পারেন বা করতে যাচ্ছেন। আমরা এমন ঘটনাও জানি পরিবারের সঙ্গে গল্পগুজব করে রাতের খাবার খেয়ে ঘরে গিয়ে একজন মানুষ গলায় দড়ি দিয়েছেন। আবার বিদেশে পড়ছে যে মেয়ে, সেই মেয়ে ছুটিতে বাবা-মায়ের কাছে এসে রাতে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমের বড়ি খেয়েছে।
অনেক সময় আমাদের অনেকের মন খারাপ থাকে, আমরা বিষণ্ণ থাকি। এমনকি কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিষণ্ণতা রোগে অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে যারা ভুগছেন, তাদের বিষণ্ণতা স্বাভাবিক মানুষের বিষণ্ণতার মতো নয়। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে যারা ভুগছেন, তাদের পুরো অস্তিত্ব গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। নিজের ওপর অনেক সময়ই তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাড়াজাগানো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটানোর আগে আবু মহসিন খান লাইভে যা যা বলেছেন, তা সবই তার একা থাকার অ-নিরাপত্তা, নিঃসঙ্গতা ও হতাশা থেকে বলেছেন। এর সঙ্গে ছিল তার ডিপ্রেশন এবং ক্যান্সার ও প্রতারিত হওয়ার কষ্ট। একটা পর্যায়ে এসে তিনি অনুভব করতে শুরু করেন যে, তিনি খুব একা। এই বিপদের সময় তার যা কিছু দরকার ছিল, যাদের দরকার ছিল, তাদের তিনি পাননি।
আবু মহসিন খানের একাকীত্বের জন্য ঠিক কে, কিভাবে দায়ী আমরা জানি না। তবে বুঝি মানুষের পক্ষে ভালোবাসাহীন পরিবেশ বহন করা খুব কষ্টের। একাকীত্ব থেকে মুক্তির জন্যই পরিবার প্রথার সৃষ্টি। আবার পরিবারকে যেন একা থাকতে না হয়, তার জন্য সমাজের সৃষ্টি। পরিবার ও সমাজের স্থান তাই ব্যক্তির ওপরে। আমরা অবশ্য ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চাপে পড়ে তা ভুলে যাই এবং স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
প্রায় ৩-৪ বছর আগে আমার পরিচিত পরিবারের একমাত্র মেয়েটি আত্মহত্যা করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়েটি ছিল অস্বাভাবিক ধরনের চুপচাপ স্বভাবের। মেয়েটির মা শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছেন, 'কেন আমরা ওকে সময় দিলাম না? কথা বললাম না ঠিক মতো, নিশ্চয়ই আমার মেয়েটা খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো।' তাই বলতে চাইছি পরিবার থাকলেই হয় না, পরিবারে দেখার মতো মানুষও থাকতে হবে।
এখনো মানুষ মনে করে সুইসাইড করা স্বার্থপরের মতো কাজ। কিন্তু মানুষ কেন এরকম মনে করে? সবার পক্ষেই খুব কঠিন অন্য আরেকজনের মানসিক কষ্ট বুঝে সত্যিকার অর্থে তা অনুভব করা। অধিকাংশ মানুষ বুঝতেই পারে না, বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে কেন লোকে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে? জানে না সিচুয়েশনাল অথবা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কথা। জানে না বাইপোলার, সিজোফ্রেনিয়া ও বর্ডারলাইন ডিজিজ কী?
অনেক রোগী ডাক্তারকে বলেছেন যে, তারা যখন আত্মহত্যা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, তখন তারা তাদের প্রিয়জনদের কথা ভাবেননি। কারণ তখন তাদের কাছে নিজেদের ব্যথাটাই খুব বেশি ছিল। মনে হতেই পারে, এটা খুব স্বার্থপরের মতো আচরণ।
আসলেই কি মানুষ আত্মহত্যা করে শুধু নিজে পালিয়ে বাঁচার জন্য? এদের চলে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও, মূল কারণ কিন্তু একটাই, আর সেটা হচ্ছে- চাপ, বিষণ্ণতা এবং হতাশা, যা তারা বহন করতে পারেননি।
আত্মহত্যা নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক ভুল ব্যাখ্যা, ভয় এবং কুসংস্কার কাজ করে। প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে যিনি আত্মহত্যা করেন, তার নিজস্ব কিছু কারণ থাকে। ডাক্তাররা কারণ বের করার চেষ্টা করেন, কিন্তু একজন মানুষের মনের মধ্যে ঠিক কী ঘুরছে এটা বোঝা কঠিন। কেন সে এই সময়ে আত্মহত্যা করলো এটা জানাও প্রায় অসম্ভব।
স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম সেই ১৭ শতকে তার 'আত্মহত্যা' বিষয়ক প্রবন্ধে লিখেছেন, 'আমি বিশ্বাস করি কোনো মানুষ কখনোই তার জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই জীবনটা তার কাছে মূল্যবান থাকে।'
'কেন সে নিজেই নিজের জীবন কেড়ে নেয়, তা আমরা কোনোদিনও জানতে পারব না। আমরা জানতে পারব না একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিচার বিবেচনা ও যুক্তি ঠিক ওই মুহূর্তে বা সুইসাইড করার আগের মুহূর্তে কী থাকে।'
মনঃচিকিৎসক ক্যাম্পবেল ওয়াট বলেছেন, 'এটা আমাদের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব যে, একজন মানুষকে তার আত্মহত্যা করার ইচ্ছের হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আমরা যদি সফল হই, যদি ব্যক্তির কারণগুলোকে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, তাহলে সেটাই হবে বড় উপহার।
কারণ যে আত্মহত্যা করে তার মৃত্যু তার পরিবারের ওপর ভয়াবহ প্রভাব রাখে। মৃত মানুষের পরিবার-পরিজন সারাজীবন একটা উত্তরবিহীন প্রশ্ন, অতৃপ্ত মন এবং গভীর শূন্যতা নিয়ে কাটিয়ে দেয়। যেমনটা কাটাবেন আবু মহসিন খানের ছেলে-মেয়েরা।
তবে মনঃচিকিৎসকরা এও বলেন যে, তারা দেখেছেন যখন রোগীদের মানসিক, শারীরিক ও আবেগজনিত অসুস্থতা চিকিৎসা দিয়ে ঠিক করা হয়, তখন সেইসব সুইসাইডাল রোগী আর মারা যেতে চান না। এভাবে অনেকেই ফিরে এসেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। ফিরে এসে বলেছেন, তারা জীবন উপভোগ করতে চান। তারা স্বীকার করেছেন যে, বিশেষ একটা অবস্থায় তারা মারা যেতে চেয়েছিলেন। তাই আমাদের সবার দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের ওই মুহূর্তটাকে ঠেকানো, তার পাশে দাঁড়ানো।
অধিকাংশ মানুষ খুব একটা পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা করে না। বিষণ্ণতা থেকে আবেগ তৈরি হয়, আশা চলে যায়, অন্য কোনো উপায় খুঁজে পায় না বলে, একমাত্র উপায় হয় তখন নিজের জীবন নিয়ে নেওয়া। আবু মহসিন খানও এই পরিকল্পিত ও নাটকীয় আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটিয়েছেন সম্ভবত ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থেকে।
বাঁচার জন্যই আমাদের পরিবার, বন্ধুত্ব, ভালবাসা, দেওয়া-নেওয়ার মতো সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে একজন অসহায়, ভেঙেপড়া মানুষের। আমরা আত্মহত্যার কারণগুলোকে আমলে নেই না বা গুরুত্ব দেই না। এটা যে সাধারণত মানসিক অসুস্থতা বা চাপ থেকে হয়, সেটাও অধিকাংশ পরিবার জানে না।
আর জানলেও এটা জানে না যে, এই মানসিক রোগীকে নিয়ে কী করতে হবে। কীভাবে তার পাশে দাঁড়াতে হবে? আমাদের কাছে মানসিক সমস্যা বা চাপ মানে পাগল হয়ে যাওয়া। এর জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়া মানে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাওয়া।
পরিবারের কোনো সদস্য কোনো বিপদে পড়লে যদি পরিবারের অন্য সদস্যরা তার পাশে না দাঁড়িয়ে, হাসাহাসি ও গালিগালাজ করে, তাহলে বুঝতে হবে আমরা তাকে বিষণ্নতার মুখে ঠেলে দিচ্ছি। বাঁচার জন্যই আমাদের পরিবার, বন্ধুত্ব, ভালবাসা, দেওয়া-নেওয়ার মতো সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে একজন অসহায়, ভেঙেপড়া মানুষের।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments