কম বয়সে বিয়ে করা উচিত নয় যে ১০ কারণে

ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাঈদ

বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজের ব্যাপারে, জীবনের লক্ষ্য ও সঙ্গীর ব্যাপারে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক প্রস্তুতি, আর্থিক নিরাপত্তা এবং নিজের চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে এসে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে তা সুন্দর দাম্পত্য জীবনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। কম বয়সে বিয়ে করলে অনেক সময়ই বিপরীত অবস্থা তৈরি হতে পারে। কারণ এর অনেক সম্ভাব্য সংকট আছে।

কম বয়সে বিয়ে করে ফেলার আগে অনেক বিষয়ের ওপর নজর দেওয়া জরুরি। কেউ কেউ আগেভাগে বিয়ে করে ফেলছে দেখেই বিয়ে ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি যে কারো জীবনের একটি অন্যতম বড় পদক্ষেপ।

যদিও কেউ কেউ তারুণ্যের শুরুতেই বিয়ের জন্য নিজেদের প্রস্তুত মনে করে, তবুও বিয়ের আগে অপেক্ষা করার বেশ কিছু সুবিধাজনক দিক আছে। এখানে আমরা উদাহারণসহ ১০টি কারণ দেখব। জনাব, কেন অল্প বয়সে বিয়ে করার আগে আপনার দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত।

জীবনমুখী অভিজ্ঞতার ঘাটতি

কম বয়সে বিয়েকে নিরুৎসাহিত করার একটি অন্যতম কারণ হলো জীবনমুখী অভিজ্ঞতার অভাব। নিজেকে চিনতে, জীবনের লক্ষ্য ও চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হতে অনেক ক্ষেত্রেই তরুণদের সময় প্রয়োজন হয়। ফলে তাড়াহুড়া করে এমন কাউকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে যে কি না তার সঙ্গে জীবন কাটানোর উপযুক্ত নয়।

ধরুন, ২ জন কম বয়সী তরুণ-তরুণী ১ বছর প্রেম করার পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন। নিজের মতো করে বেঁচে থাকার কিংবা ঘোরাঘুরি করার সুযোগও এখনো তাদের হয়নি। এ অবস্থায় বিয়ে করলে সংশ্লিষ্ট আরও নানা রকম দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা তাদের ওপর চলে আসবে, যা সামলানোর মতো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। ফলে দাম্পত্য জীবনে নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

আর্থিক প্রস্তুতি না থাকা

আর্থিকভাবে প্রস্তুত না থাকা আরও একটি অন্যতম বিষয়, যার কারণে কম বয়সে বিয়ের পরিণতি সুখকর নাও হতে পারে। তরুণ কোনো দম্পতির নিরাপদ নির্দিষ্ট আয়ের উৎস না থাকার আশঙ্কা থাকে, যা তাদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিংবা সবেমাত্র অল্প বেতনে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা কোনো জুটির কথা ভাবুন। তাদের জন্য কিন্তু বিয়ের পর একে অন্যকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। হয়তো তাদের একজনের বেতনে মাস কাটাতে হবে, যার প্রভাব পড়বে তাদের সম্পর্কে।

ক্ষুদ্র সামাজিক পরিমণ্ডল

কম বয়সী দম্পতিদের সামাজিক পরিমণ্ডলও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরিসরের হয়ে থাকে। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে সম্বল কিংবা সহায়তার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বয়স কম হলে এলাকায় পরিচিতি পাওয়া, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করা কিংবা বিভিন্ন সামাজিক পরিমণ্ডল খুঁজে পাওয়ার মতো কঠিন কাজগুলো তাদের করতে হয়। ফলে পারিপার্শ্বিক সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারটি চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।

ধরুন, এক কম বয়সী দম্পতি সবেমাত্র নতুন এলাকায় বাসা নিয়েছেন। এই অবস্থায় নতুন মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে একটি আশ্রয়ের স্থান গড়ে তোলা খুব সহজ কিছু নয়। যদি নিজেদের সম্পর্কেও কোনো টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়, তাহলেও কিন্তু তাদের আশপাশ থেকেই সমর্থন কিংবা পরামর্শের প্রয়োজন হতে পারে।

ব্যক্তিত্বের অসম্পূর্ণ বিকাশ

ব্যক্তিত্বের বিকাশ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া; বিয়ের মতো একটি সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে যার পথটা তেমন মসৃণ নাও হতে পারে। তারুণ্যেও নিজেকে চেনার, নিজের চাওয়া-পাওয়াকে বোঝার সফর চলতে থাকে। দায়িত্বশীল একটি সম্পর্কে থেকে এই সফর অনেকসময়ই খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠে।

ধরুন, ক্যারিয়ার নিয়ে বোঝাপড়ার মাঝেই একজন তরুণী বিয়ে করলেন। এ অবস্থায় তার হয়ত বৈবাহিক জীবনে মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। একটা সময় তার মনে হতেই পারে, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার আর কোনো সুযোগ নেই এবং হয়তো খুব দ্রুতই তিনি তার বিয়ের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করবেন।

প্রাধান্যের পরিবর্তন

সময়ের সঙ্গে আমাদের জীবনে প্রাধান্য বদলে যেতে থাকে। ৩০ বা ৪০ এর ঘরে বয়স থাকতে যেসব বিষয় আমরা প্রাধান্য দিই, তা ২০ এর ঘরে যা প্রাধান্য দেই তার চেয়ে যথেষ্ট আলাদা হয়। কম বয়সে আমাদের প্রাধান্য কোনো জায়গায় স্থির তাকে না। এক্ষেত্রে যদি স্বামী-স্ত্রী ২ জনই একই সমান্তরালে না থাকেন, তবে তা সম্পর্ক তিক্ত করতে পারে।

তরুণ দম্পতির ২ জনই যেহেতু তরুণ, তাই তাদের মাঝে ভবিষ্যতের জন্য ভিন্ন ভাবনা এবং চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে। একজন হয়তো চাইছেন একসঙ্গে নিজেদের বাড়িতে থেকে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে পরিবার শুরু করতে, আবার অন্যজনের চাওয়া হয়তো বিশ্বের আনাচে কানাচে ঘুড়ে বেড়ানো। কম বয়সে চাওয়া-পাওয়ার এই ভিন্নতায় যে অস্থিরতা এবং সংকট তৈরি হয়, তা দাম্পত্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিয়ে বিচ্ছেদের উচ্চ ঝুঁকি

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিকভাবে পরিপক্ক হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসা দম্পতিদের তুলনায় অল্প বয়সে বিয়ে করা দম্পতির মাঝে বিচ্ছেদের হার অপেক্ষাকৃত বেশি। মানসিক অপরিপক্কতা, জীবনমুখী অভিজ্ঞতার অভাব এবং আর্থিক অনিশ্চয়তা এসব বিচ্ছেদের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে।

যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান বিভাগের নির্বাহী কার্যালয় অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকসের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ২০-২৫ বছরের মাঝে বিয়ে করেন তাদের বিচ্ছেদের আশঙ্কা ৩০ এর ঘরে যারা বিয়ে করেন তাদের তুলনায় বেশি।

ভুল সঙ্গী বাছাই  

অনেক সময় তরুণ-তরুণীদের পরিবার ও আত্মীয় স্বজনরা বিয়ের জন্য চাপ দেয়। ফলে তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নিয়ে এমন কারো সঙ্গে হয়তো তারা গাঁটছড়া বাঁধেন, যে কি না তার জন্য উপযুক্ত নন।

একজন তরুণীর কথাই ভাবুন, যাকে হয়তো স্বজনরা বিয়ে করে বাচ্চা নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। মেয়েটিও হয়তো এক সময় ভাবলেন, আসলেই তো! সময় তো চলে যাচ্ছে। এরপর হয়তো খুব বেশি না ভেবে এমন কাউকে বিয়ে করে ফেললেন যে কি না তার জন্য সঠিক নন।

জীবনের অন্যান্য সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলা

অল্প বয়সে বিয়ের জন্য নানা রকম মাশুল গুণতে হতে পারে। সংসার গড়ায় অঙ্গীকার করতে গিয়ে হয়তো ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদে অনুশোচনা ও ক্ষোভের কারণ হতে পারে।

হয়তো কোনো তরুণ বা তরুণী তার কাজের ব্যাপারে বেশ মনোযোগী, নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু ওই বয়সে বিয়ে করলে তার কর্মজীবন নিয়ে আপস করতে হতে পারে। সংসারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে একটা সময় হারিয়ে ফেলা দিনগুলো তাকে অনুশোচনায় আটকে ফেলতে পারে।

মানসিক পরিপক্কতার ঘাটতি

যেকোনো সম্পর্কের জন্য মানসিক পরিপক্কতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি অর্জন করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়। অল্প বয়সে বিয়ে করলে, এর সঙ্গে আসা নানা রকম সংকট সামাল দিতে যে মানসিক অবস্থা থাকা দরকার তা নাও থাকতে পারে।

মানসিক পরিপক্কতার ঘাটতির কারণে কোনো তরুণ দম্পতিকে ফলপ্রসূ উপায়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং সম্পর্কের কোনো দ্বন্দ্ব সামাল দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে পারে। দাম্পত্য জীবনের সংকটগুলো সঠিকভাবে বুঝতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে, তাদের তখনও আত্ম-সচেতনতা এবং মানসিক নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা বিকাশের প্রয়োজন হতে পারে।

একসঙ্গে বড় হয়ে উঠার চ্যালেঞ্জ

আমরা প্রত্যেকেই মানুষ হিসেবে বদলে যাচ্ছি এবং মানসিকভাবে পরিপক্ক হচ্ছি, তাই একসঙ্গে বেড়ে উঠা এমনিতেই বেশ চ্যালেঞ্জিং একটি ব্যাপার। তবে অল্প বয়সী দম্পতিদের জন্য এটি আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। কারণ বয়স বাড়তে থাকলে আমরা অনেক সময়ই নিজেদের জীবনের নতুন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আবিষ্কার করি, যা কি না সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে।

তরুণ দম্পতির কাছে বয়সের সঙ্গে মানসিকভাবে বেড়ে ওঠা এবং একসঙ্গে সেই বদলের পথে হাঁটা কঠিন মনে হতে পারে। সময়ের সঙ্গে হয়তো তাদের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ও প্রাধান্য বদলে যেতে থাকবে। এতে করে পারস্পারিক বোঝাপড়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

অনুবাদ করেছেন আনজিলা জেরিন আনজুম

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago