কেন বাংলাদেশি কনেরা লাল পরেন, কেনই বা বদলাচ্ছে এই চিত্র

বিয়েতে লাল শাড়ি
ছবি: এম এইচ বিপু

লাল রংকে বলা হয় সাহসের প্রতীক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের নারীরা বিয়েতে এই ঐহিত্যবাহী রঙের পোশাক পরেন। কিন্তু এই রঙের এত আধিপত্য? এখন কেনই বা আমরা বিয়ের পোশাক হিসেবে গোলাপি, সাদা এমনকি সবুজ রং নিয়েও নিরীক্ষা করতে দেখছি?

বাংলাদেশি একটি বিয়ের দৃশ্য কল্পনা করুন। যেখানে বিয়ের আসরে প্রবেশ করছেন কনে, যার পরনে জমকালো লাল রঙের শাড়ি, আলোর নিচে যা ঝলমল করে উঠল।

লাল হলো সাহসের প্রতীক, প্রাণবন্ত রং এবং একইসঙ্গে কর্তৃত্বপরায়ণও বটে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশি কনেরা বিয়ের পোশাক হিসেবে এই রংকেই বেছে নিয়েছেন। কিন্তু রঙের সঙ্গে কেন বিয়ের কনের এই দারুণ সখ্য? আর কেনই বা আমরা এখন গোলাপি, সাদা এমনকি সবুজের মতো রঙেও বিয়ের কনেকে দেখছি?

লাল রঙের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য: শক্তি আর আবেগের রং

দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিতে লাল সবসময়ই শ্রদ্ধা এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। লাল হলো জীবনের রং, জীবনীশক্তির প্রতীক এবং শুভ সূচনার চিহ্ন। বিয়ের প্রেক্ষাপটে লাল উর্বরতাকে নির্দেশ করে, উন্নতি-সমৃদ্ধি এবং দাম্পত্য জীবনের সুখের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। আর ঐহিত্যগতভাবে কনেরা এসব বৈশিষ্ট্য লালন করেন বলে ধরে নেওয়া হয়।

বিয়েতে লাল শাড়ি
ছবি: এম এইচ বিপু

বাঙালি বিয়েতে লাল রঙের ব্যবহার যেন নান্দনিকতার চাইতেও বেশি কিছু।

খানসাব স্টুডিওর স্বত্ত্বাধিকারী ও ডিজাইনার শাফায়েত হোসেন খান বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললেন, 'বাঙালি বিয়েতে লাল রঙের ব্যবহার আবেগ আর শক্তির সন্নিবেশ ঘটায়, নতুন সম্পর্কের সূচনাকে করে মূর্ত। আমি মনে করি, লাল রঙ নববধূর সাহস আর নতুন সম্পর্কের যাত্রায় তার ভালোবাসাকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমি ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে এবং কনের আবেগকে ফুটিয়ে তুলতে লাল রঙের পোশাক বিয়ের জন্য বেছে নিই।'

মনস্তাত্ত্বিক বিচারে, লাল সার্বজনীনভাবেই আকর্ষক রং হিসেবে পরিচিত। এটা আত্মবিশ্বাস ও শক্তির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। কনেকে তার বিশেষ দিনে অর্থাৎ বিয়ের দিন লাল রঙের পোশাক পরলে উজ্জ্বল দেখায়, রাজকীয় দেখায়। লালের এতসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই বিয়ের মতো জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব উদযাপনে লাল রঙের পোশাক অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

ঐহিত্য বনাম পছন্দের গল্প

সম্প্রতি বিয়ে করেছেন সিলভিয়া মাহজাবিন। কথা হলো তার সঙ্গে। জানালেন বিয়ের পোশাকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত হওয়ার কথা।

সিলভিয়া বলেন, 'আমার বাড়ির লোকেরা আমাকে লাল রঙের কনে হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। সে কারণেই আমি বিয়েতে লাল জামদানি পরার সিদ্ধান্ত নিই।'

'আমি ব্যক্তিগতভাবে লাল কনে হতে চাইনি। আসলে নিজের পছন্দের চেয়ে এক্ষেত্রে সামাজিক আর পারিবারিক প্রেক্ষাপট বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এমনকি আমার বোন যিনি ২০১৫ সালে বিয়ে করেছেন, তিনিও লাল শাড়িই পরেছিলেন। কারণ, আমাদের চারপাশের সবাই লাল রঙের শাড়ি বা লেহেঙ্গা পরেই বিয়ে করেছে।'

সিলভিয়ার এই গল্পের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, কীভাবে সামাজিক প্রত্যাশা বা সামাজিক চাপ আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে। এমনকি আধুনিক কনেরা, যারা ঐহিত্যকে তেমন পরোয়া করেন না, তারাও দিনশেষে লাল রংকেই বিয়ের পোশাকের রং হিসেবে বেছে নেন।

অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে ব্রাইডাল ফ্যাশন বা বিয়ের পোশাকের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ইনস্টাগ্রাম বা পিন্টারেস্টের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিয়ের ছবি দেখার সুবাদে দেশের নববধূরাও গতানুগতিকতার বাইরে চিন্তা করতে পারছেন। ফলে গোলাপি, সাদা, বিভিন্ন প্যাস্টেল রঙের শেড এমনকি গাঢ় সবুজ বা নীল রংও বিয়ের কনের পোশাকের রঙ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জামদানি ও লাল

ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে চমৎকার বিয়ের শাড়ি নকশা করতে অনেক ডিজাইনারই বেছে নিচ্ছেন লাল জামদানি।

শাফায়েত খান ব্যাখ্যা করে বললেন, 'বিয়ের জন্য জামদানি বেছে নেওয়ার অর্থ হলো, দেশি সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে এর সূক্ষ্ম যে সৌন্দর্য আছে তাকে কনের শরীরে জড়িয়ে দেওয়া। ঐতিহ্যবাহী এই কাপড়টির বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত এক ধরনের আবেগ কাজ করে। লাল জামদানির ওপর কার্নেশন ফুলের নকশা যুক্ত করে আমি সেই ঐহিত্যবাহী শিল্পটিকেই নিজের জায়গা থেকে শ্রদ্ধা জানাই।'

জামদানি শাড়ির বয়ন প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। একটি শাড়ি বুনে শেষ করতে কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে। এর সূক্ষ্ম বুননই বিয়ের পোশাক হিসেবে জামদানিকে অনন্য করে।

শাফায়েত খান বলেন, 'জামদানি শব্দের অর্থ ফুলদানি। যা আমাদের কার্নেশন ফুলের মোটিফের সঙ্গে চমৎকারভাবে মানিয়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী জামদানির সঙ্গে ফরাসি শিল্প থেকে অনুপ্রাণিত ফ্লোরার এমব্রয়ডারির মেলবন্ধন ঘটিয়েছে খানসাব স্টুডিও। এর মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশি কাপড়ের ঐতিহ্যকে যেমন সংরক্ষণের চেষ্টা করছি, তেমনি এতে দিচ্ছি আধুনিকতার ছোঁয়াও।'

কীভাবে আসছে বিয়ের পোশাকের রঙে পরিবর্তন?

কথা হয় সাদিয়া রহমানের সঙ্গে, যিনি বিয়ের দিন পরেছিলেন গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা।

তিনি বলেন, 'গোলাপি রং আমার জন্য খুবই বিশেষ কিছু, আমার কাছে গোলাপিকে অনেক বেশি অভিজাত মনে হয়। শুরুতে আমার পরিবারের সদস্যরা কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন, কারণ তাদের কাছে গোলাপিকে কনের রং বলে মনে হচ্ছিল না। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি যখন আমি গোলাপি পোশাকে বউ সাজলাম, সেটি দেখে তারা সন্তুষ্ট ছিলেন, খুশি হয়েছিলেন। তখন তাদের কাছে গোলাপিকেই বিয়ের রং বলে মনে হচ্ছিল।'

ফ্যাশনের বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশের কনেরা এখন সহজেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের কনেরা বিয়েতে কোন রং বা কেমন পোশাক পরছেন তা দেখতে পারছেন। পশ্চিমা কনেরা সাধারণত বিয়ের রং হিসেবে গোলাপি এবং সাদাকে বেছে নেন। একই সময়ে দক্ষিণ এশিয় ডিজাইনাররাও অপ্রচলিত রং দিয়ে বিয়ের পোশাক নকশা করতে শুরু করেছেন। এখন বাঙালি কনেরা পশ্চিমা শৈলী থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছেন এবং নিজেদের ঐতিহ্যের সঙ্গে তার সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন।

ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ করেন তাসনিম হক। নিজের বিয়ের পোশাক বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। বিয়েতে সাদা রঙের পোশাক পরেছিলেন তিনি।

তাসনিম বলেন, 'আমি সবসময়ই প্রচলিত রীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছি। তাই বিয়েতে সাদা রঙের পোশাক বেছে নেওয়াটা ছিল অনেকটা আমার জবাবের মতো। পোশাকটা ছিল পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম এবং সুন্দর। বিশেষ দিনে ঠিক এমন পোশাকেই নিজেকে দেখতে চেয়েছিলাম আমি।'

আধুনিক সময়ের কনেরা ঐতিহ্যের কঠোর অনুশাসন থেকে বেরিয়ে নিজের ব্যক্তিগত চাওয়াকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। ফলে একজন কনে চাইলেই নিজের কোমল ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন হিসেবে সাদা রঙের পোশাক বেছে নিতে পারেন। আবার সবার চেয়ে আলাদা দেখাতে বেছে নিতে পারেন পান্না সবুজ রঙের পোশাকও।

বাংলাদেশি বিয়ের পোশাকের ভবিষ্যৎ

লালের ছাঁচ থেকে বাংলাদেশের কনেরা যত বেশি মুক্ত হচ্ছেন, দেশের ব্রাইডাল ফ্যাশন তত বেশি উজ্জ্বল আর রঙিন হচ্ছে। তবে লাল সবসময়ই ঐতিহ্যের রং হিসেবে টিকে থাকবে। এটি অন্যান্য রঙের সঙ্গে সহাবস্থান করবে এবং ব্যক্তি ও তার ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী বিয়ের পোশাকে ব্যবহৃত হবে।

সবশেষে এটাই বলতে চাই যে, পোশাকের রং নয় বরং কনের আত্মবিশ্বাস আর সুখই হলো মূল কথা। ঐতিহ্যবাহী লাল, রোমান্টিক গোলাপি, ছিমছাম সাদা কিংবা গাঢ় সবুজ; পোশাকের রং যা-ই হোক না কেন প্রতিটি কনেরই অধিকার আছে তার বিশেষ দিনে সুন্দর আর সেরা দেখানোর।

ডিজাইনার: শাফায়েত হোসেন খান (খানসাব স্টুডিও)

মেকআপ আর্টিস্ট: জাহিদ খান

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

15h ago