পারফেকশনিজমের ৪ লক্ষণ: বিষাক্ত করতে পারে কর্মক্ষেত্র

ছবি: সংগৃহীত

নিজের কাজটা সবেচেয়ে ভালোভাবে করতে চাওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে, আপনি যদি পারফেকশনিস্ট হওয়ার পথে হাঁটেন, তাহলে অনেক সময় নিজের কাজগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন অসম্ভব এবং অবাস্তব হয়ে ওঠে।

পারফেকশনিজম সব সময় খারাপ নয়। এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিজেদের পারফেকশনিজমের উচ্চ মানদণ্ডে মূল্যায়ন করেন, তারা সব সময় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাজ করেন এবং কাজের সঙ্গে নিজেকে সর্বদা নিযুক্ত রাখেন। যা পরবর্তীতে তাদের সফল হতে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু সমস্যা তখনই হয়, যখন পারফেকশনিস্টের কঠোর মানদণ্ডগুলো ভালোর চেয়ে বেশি পরিমাণে ক্ষতি করতে শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ও উইসকনসিনের স্টেটস অব ওয়েলনেস কাউন্সেলিংয়ের একজন সাইকোথেরাপিস্ট শ্যানন গার্সিয়া বলেছেন, 'পারফেকশনিজম হলো এক ধরনের উদ্বেগ। আপনার পারফেকশনিজম এমনও হয়ে উঠতে পারে যা আপনাকে আপনার ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে দিতে পারে। দেখা যায়, আপনি হয় ভয়ে কাজগুলো এড়িয়ে চলতে শুরু করেছেন—এই ভেবে যে, হয়তো নিখুঁতভাবে কাজটি করা যাবে না। কিংবা আপনি কোনো একটি কাজ নিখুঁত করার চেষ্টায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেন।'

এগুলো কাউকে বিষাক্ত পারফেকশনিজম মানসিকতার দিকে পরিচালিত করতে পারে। যা একসময় আপনার স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে।

টকসিক (বিষাক্ত) পারফেকশনিজমের কয়েকটি লক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করা হল-

আপনি যা করেননি তা নিয়েই কেবল চিন্তা করেন এবং আপনি যা অর্জন করেছেন সেটিকে গুরুত্ব দেন না

আপনি যা অর্জন করেছেন তা যদি আপনি অনুধাবন করতে না পারেন, তাহলে আপনি কখনই সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। মনোবিজ্ঞানী পারপেচুয়া নিও ব্যাখ্যা করেছেন, একজন পারফেকশনিস্টের কাছে তাদের কাজের পারফরম্যান্সের গ্রেডিং, '০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত খারাপ এবং কেবল ১০০ গ্রহণযোগ্য।'

পারফেকশনিস্টরা প্রশংসা গ্রহণ করেন না এবং তারা তাদের সূক্ষ ভুলগুলো নিয়ে শুধু পড়ে থাকেন। আর এই ধারাবাহিক চাপ তাদের একসময় ক্লান্ত করে তোলে।

নিউজার্সি-ভিত্তিক সাইকোথেরাপিস্ট অ্যাঞ্জেলা ক্ল্যাক বলেন, 'পারফেকশনিস্ট মানসিকতায় আপনি যখন আপনার লক্ষ্যে পৌঁছান, তখন আপনার পরবর্তী চিন্তা থাকে শুধু, 'পরবর্তীতে কী আসবে?' সে বিষয়ে।'

ক্ল্যাক আরও বলেছেন, 'তারা তাদের প্রতিযোগীদের দেখে কীভাবে আরও ভালো করতে হবে সে বিষয়ে চিন্তা করেন এবং ফিনিশ লাইনটি এভাবে আরও দূরে সরে যেতে থাকে, যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে ওঠেন। যার ফলে, তারা কখনই তাদের জয়ের মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে পারেন না।'

কর্মক্ষেত্রে এরকম দীর্ঘ চাপের কারণে ফলাফল হয় মানসিক অবসাদ। দীর্ঘমেয়াদে যা আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। এর কারণে দেখা দিতে পারে মাথাব্যথা, অনিদ্রা, ডিপ্রেশনসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা। তাই কোনো কাজ শেষে, আপনি যতটুকু করেছেন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা এবং ভালো বোধ করা উচিত।  

আপনি ও আপনার সহকর্মীরা নির্ধারিত হাই-স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছাতে না পারলে কী হবে, সে বিষয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হওয়া

মিয়ামি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা এবং জর্জিয়া টেকের গবেষকরা ৯৫টি পূর্ববর্তী গবেষণা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন ২ ধরনের পারফেকশনিস্ট রয়েছে। 

গবেষণাটির সহ-গবেষক এবং ম্যানেজমেন্ট অধ্যাপক লরেন্স স্টিড বলেন, 'একদল হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব-সন্ধানকারী পারফেকশনিস্ট। যারা নিজেদের এবং অন্যদের জন্য অত্যধিক হাই-স্ট্যান্ডার্ড দাবি করেন। অন্যদিকে, আরেক দল হচ্ছে, ব্যর্থতা-এড়িয়ে যাওয়া পারফেকশনিস্ট। যারা কোনো একটি কাজের জন্যে অত্যন্ত হাই-স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে রাখেন এবং এই হাই-স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়াকে ঘৃণা করেন।'

উদাহরণস্বরূপ, আপনার কোনো অ্যাসাইনমেন্টের জন্য যদি হাই-স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে রাখেন এবং তা শেষ না করার চিন্তায় যদি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তাহলে সেটি ব্যর্থতা এড়িয়ে যাওয়া পারফেকশনিস্টের একটি চিহ্ন হতে পারে।  

স্টিডের সমীক্ষায় দেখা গেছে, শ্রেষ্ঠত্বসন্ধানী পারফেকশনিজম যেখানে অনুপ্রেরণা ও নিজেকে কাজে নিযুক্ত রাখার সঙ্গে সম্পর্কিত সেখানে ক্লান্তি, স্ট্রেস এবং উদ্বেগ ব্যর্থতা এড়িয়ে যাওয়া পারফেকশনিজমের সঙ্গে আরও দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে একজন পারফেকশনিস্ট হওয়া কোনোভাবে কাজের পারফরম্যান্সকে উন্নত করেনি। তা সেটা যে ধরনের পারফেকশনিজমই হোক না কেন।

স্টিড বলেন, 'আমাদের ফলাফলগুলোগুলো থেকে দেখা যায়, পারফেকশনিজম মূলত কর্মক্ষেত্রে সহায়ক নয়। যদিও খুব বেশি পারফেকশনিস্ট হওয়ার কিছু উপকারী ফলাফল রয়েছে। কিন্তু, এই সুবিধাগুলো নেতিবাচক ফলাফলের বিপরীতে বাদ দেওয়া যায় এবং এতে সামগ্রিক কর্মক্ষমতায় খুব একটা প্রভাব পড়ে না।'

আপনার কাজ যথেষ্ট ভালো হয়নি ভেবে আপনি ডেডলাইন মিস করছেন

গার্সিয়া বলেন, 'আপনার পারফেকশনিজম ভালোর চেয়ে মন্দ বেশি করার একটি লক্ষণ হলো, যখন তা আপনাকে কিছু করতে দিচ্ছে না।' 

তিনি বলেন, 'আপনি কাজগুলো বারবার ঠিক করতে থাকেন, যার কারণে ডেডলাইন পেছাতে থাকে। আপনার কাজ কখনই আপনার কাছে যথেষ্ট ভালো মনে হয় না, অথবা কাজটি আপনি সম্পন্ন করতে পারবেন না এই ভয়ে কোনো কাজ শুরু করতে আপনার সমস্যা হয়।'

'ডেডলাইন মিস করার জন্য আপনি আপনার দলে কুখ্যাত হয়ে পড়বেন। এই মনোভাব যদি একবার আপনার মনে স্থির হয়ে যায়, তাহলে আপনার ক্যারিয়ারে অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।'

গার্সিয়া দেখেছেন, পারফেকশনিজম শুধু অবসাদের কারণ নয় বরং আপনি আপনার বস এবং সহকর্মীদের কাছেও হতাশার কারণ হতে পারেন। আর এই মানসিক চাপ, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে আপনার ব্যক্তিগত জীবনেও চলে আসতে পারে।

আপনি 'পারফেক্ট নয়' ভেবে সামাজিকীকরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন

নিও বলেছেন, 'আপনার পারফেকশনিজম আপনার জন্যে ক্ষতিকারক হয়ে উঠার একটি লক্ষণ হলো, আপনি সহকর্মী বা প্রিয়জনদের কথা শুনতে বা তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না। কারণ আপনি নিজের একটি নিখুঁত ইমেজ বজায় রাখার বিষয়ে বেশি চিন্তিত।'

'পারফেকশনিজম একজন ব্যক্তিকে তাদের সহকর্মীদের আশেপাশে থাকা থেকে বিরত রাখতে পারে। কারণ তারা ভাবে, সহকর্মীরা যদি তাদের আসল রূপ সম্পর্কে জানে তাহলে কেউ তাদের পছন্দ করবে না। তারা এই সামাজিক মুখোশটি পরার জন্য নিজেদের ওপরই অবিশ্বাস্য চাপ দিতে থাকে।'

মনোবিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন যে, নিজেদের জন্য অবাস্তব মানদণ্ড নির্ধারণ করা পারফেকশনিস্টদের পাশাপাশি, 'সোস্যালি প্রেসক্রাইবড' পারফেকশনিস্ট আছেন, যারা মনে করেন যে সমাজ বা তাদের আশেপাশের মানুষ তাদের ওপর অসম্ভব প্রত্যাশা চাপিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে হতাশা এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

আপনার পারফেকশনিজম আপনার ক্যারিয়ারে সাহায্য বা ক্ষতি করছে কি না তা নিয়ে আপনি যদি চিন্তিত হন, সেক্ষেত্রে নিও নিজেকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে বলেন। 'এটি কি আপনার জীবনকে সংকূচিত করে ফেলছে? এটি কি আপনাকে অসুখী, উদ্বিগ্ন করে তুলছে? আপনার কি মনে হচ্ছে, আপনি বাইরে নিজের যে রূপ উপস্থাপন করছেন তার মধ্যে একটি ফাটল ধরেছে এবং আপনি অনুভব করছেন যে তা যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে চলেছে?'

আপনার যদি কোনোটির উত্তর হ্যাঁ-সূচক হয়, তাহলে পারফেকশনিজম আপনাকে আসলে আর সাহায্য করছে না এবং এক্ষেত্রে আপনার মানদণ্ডগুলো পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

 

তথ্যসূত্র: হাফপোস্ট, গুগল নিউজ

গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

13h ago