মানসিক স্বাস্থ্যে তাপদাহের প্রভাব

ছবি: সংগৃহীত

তীব্র গরম ও আর্দ্রতা মোটামোটি সবার কাছেই অস্বস্তিকর। তবে গবেষণা বলছে, এই ধরনের পরিস্থিতি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর হতে পারে। অত্যধিক তাপমাত্রা মন ও মেজাজকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি এর কারণে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও হতে পারে।

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপদাহ, দাবানল ও আবহাওয়া-সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনাগুলোর পরিমাণ ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এর বিরূপ প্রভাবও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের কম্পিউটেশনাল সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করা নিক ওব্রাডোভিচ বলেছেন, 'আমরা অনেক ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখতে পাচ্ছি, যা উত্তাপের চরম মাত্রার ফলে হচ্ছে।'

গবেষণায় ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সঙ্গে মানসিক অবসাদ, আগ্রাসন, এমনকি আত্মহত্যার উচ্চ হারসহ বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। যদিও মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা তাপমাত্রার বাইরেও বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করতে পারে।

ড. ওব্রাডোভিচ বলেন, 'চরম তাপমাত্রা প্রতিদিনের মেজাজ থেকে শুরু করে তীব্র মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা পর্যন্ত সবকিছুকে প্রভাবিত করতে পারে।'

জেএএমএ সাইকিয়াট্রি জার্নালে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ২ দশমিক ২ মিলিয়নেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্কদের মেডিকেল রেকর্ড যাচাই করা হয়। যারা ২০১০ এবং ২০১৯ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ২ হাজার ৭৭৫টি কাউন্টি থেকে জরুরি বিভাগে গিয়েছিলেন। গবেষকরা দেখেন যে, গ্রীষ্মের উষ্ণতম দিনগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য বছরের শীতলতম দিনগুলোর তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশ বেশি মানুষ জরুরি বিভাগে গমন করেন। জরুরি বিভাগে গমনের কারণগুলোর মধ্যে ছিল, উদ্বেগ, স্ট্রেস, খারাপ মেজাজ, সিজোফ্রেনিয়া, সেলফ-হার্ম, বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা। যেগুলো তাপমাত্রার অনুপাতে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছিল।

অন্যান্য গবেষণায় আরও পাওয়া গেছে যে, উচ্চ তাপমাত্রা বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অস্থায়ীভাবে পুনরায় আক্রান্ত করাতে পারে এবং উচ্চ সূর্যালোকের এক্সপোজার ম্যানিক এপিসোডের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা সিজোফ্রেনিয়া এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় আক্রান্ত লোকেদের মৃত্যুর সঙ্গেও জড়িত।

২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন আমেরিকানদের মধ্যে এক সমীক্ষা করে জানা যায়, যে দিনগুলিতে তাপমাত্রা ৫০ এবং ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছিল তার তুলনায় যে দিনগুলিতে তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে দিনগুলোয় উত্তরদাতারা কম আনন্দ এবং সুখ অনুভব করছিলেন। সেইসঙ্গে অধিক মানসিক চাপ, রাগ ও ক্লান্তি অনুভব করার মাত্রাও কম তাপমাত্রার দিনগুলোর থেকে বেশি ছিল। আর এসকল সমস্যাগুলো আরও তীব্র ছিল যখন তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রির উপরে ছিল।

শরীরের মধ্যে তাহলে কী ঘটছে?

ডালাসের ইউটি সাউথওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টারের ক্লিনিকাল নিউরোসাইকোলজিস্ট সি. মুনরো কুলাম বলেন, 'তাপের কারণে সৃষ্ট অস্বস্তি এবং শরীর ঠাণ্ডা হতে যে শক্তি খরচ হয় তা সামগ্রিক সহনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে। তাই উত্তেজনা, জ্বালা এবং ব্যথা কম সহনীয় হয়ে ওঠতে শুরু করে তখন।'

লরিয়েট ইনস্টিটিউট ফর ব্রেন রিসার্চ অফ তুলসা, ওকলার সভাপতি এবং বৈজ্ঞানিক পরিচালক ডা. মার্টিন পলাস বলেন, 'আমাদের দেহ একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত মানসিক চাপ নিতে অভ্যস্ত। তাপদাহের সময় যখন শরীর তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, তখন মানসিকভাবে অতিরিক্ত চাপ যোগ হয় এবং এর ফলে স্ট্রেস ও প্রদাহ আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে, তাদের জন্য এই অতিরিক্ত তাপ-চাপ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।'

ড. নরি-সারমা বলেন, 'বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে তাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে যোগসূত্রটি এতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, তা ইঙ্গিত দেয় তাপ মস্তিষ্কে কিছু না কিছু করছে।'

কিছু গবেষক অনুমান করছেন, তাপ মস্তিষ্কের সংকেত আদান-প্রদানে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া তাপ মস্তিষ্কে প্রদাহের কারণও হতে পারে।  কিন্তু আরেকটি বিশেষ তত্ত্ব হলো, তাপ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, যার ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলি আরও প্রকট হয়।

ড. ওব্রাডোভিচ বলেন, 'গরমের রাতগুলো ঘুমের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করে এবং আমরা মনোবিজ্ঞান ও মনোরোগবিদ্যার একটি বৃহৎ অংশ থেকে জানতে পারি, অপর্যাপ্ত ঘুম, ঘুমের অসুবিধা ও অনিদ্রা সময়ের সঙ্গে খারাপ মানসিক স্বাস্থ্য খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।'

তাহলে নিজেকে রক্ষা করবেন কীভাবে?

তীব্র তাপদাহের মধ্যে, নিজেকে সবসময় রক্ষা করাও বেশ কঠিন। যাদের নিয়মিত বাইরে চলাফেরা করতে হয় তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আরও জটিল।

তবে এক্ষেত্রে প্রথমেই আপনি সারাদিনে কী পরিমাণ তাপে এক্সপোজড হন, সে সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। যদি তাপে এক্সপোজারের মাত্রা বেশি হয়, অর্থাৎ আপনি যদি বেশি সময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রায় থাকেন, তাহলে সেটি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।

তীব্র গরমে হাইড্রেটেড থাকার বিকল্প নেই। অতিরিক্ত তাপে আপনার শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে পড়লে, সেটির প্রভাব শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রকটভাবে পড়বে। তাই প্রচুর পরিমাণে তরল পদার্থ বিশেষ করে পানি পান করার চেষ্টা করুন।

যখনই পারবেন তাপ এড়িয়ে চলুন। প্রখর রৌদ্রে প্রয়োজন ব্যতীত চলাফেরা না করাই শ্রেয়। যদি করতেই হয় তবে সবসময় একটি ছাতা ব্যবহারের চেষ্টা করুন।

তথ্যসূত্র

নিউ ইয়র্ক টাইমস

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh bank reform plan 2025

Inside the 3-year plan to fix banks

Bangladesh has committed to a sweeping overhaul of its troubled financial sector, outlining a detailed three-year roadmap as part of its latest agreement with the International Monetary Fund.

10h ago