মহামারিতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ৮৪.৬ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী

পুরুষের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীদের সমস্যা বেশি

করোনা মহামারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। শিক্ষার্থীভিত্তিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপ বলছে, এ হার ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ। যাদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থীর তুলনায় নারী শিক্ষার্থীরা এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বেশি।

গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের ২ হাজার ৫৫২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ওপর চালানো ওই জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে।

এতে দেখা যায়, মহামারিতে পুরুষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮০ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।

এছাড়াও মহামারিতে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। অনলাইন শিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার ব্যাপারে লাইকার্ট স্কেলে ১-৫ স্কোরের মধ্যে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ অত্যন্ত অসন্তুষ্টি এবং ২১ দশমিক ৬ শতাংশ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৫৪১ জন অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বলে মনে করেন। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ১ হাজার ৫৩৭ জন শিক্ষার্থী একাকিত্বকে দায়ী করেছেন। ১ হাজার ৫৮ জন শিক্ষার্থী সেশনজটকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১ হাজার ২৮ জন টিউশন চলে যাওয়ায় এবং আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মানসিক অশান্তিতে ভুগছেন।

মহামারিতে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য ১ হাজার ৫৮১ জন শিক্ষার্থী মুভি বা ওয়েব সিরিজ দেখেছেন। সরাসরি অথবা ভার্চুয়ালি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন ১ হাজার ৯ জন। গান শুনেছেন ১ হাজার ৫ জন। ধর্মীয় দিকে মনোনিবেশ করে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি করেছেন ৯৭৪ জন। বই পড়েছেন ও অনলাইন কোর্স করেছেন যথাক্রমে ৯৭৭ জন ও ৭৯৫ জন। অনলাইনে গেম খেলেছেন ৭২৩ জন, খেলাধুলা করেছেন ৬৪১ জন।

মহামারিতে ঘুমের সমস্যা হয়েছে ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দেখা যায় ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী যথাযথভাবে ঘুমাননি।

লকডাউন পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসসহ অন্যান্য কারণে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা স্ক্রিনে সক্রিয় থেকেছেন। ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা স্ক্রিনে সময় দিয়েছেন ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছেন ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।

জরিপে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে থাকায় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। যা তাদের মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতির কারণ।

বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মাথাব্যথা এবং চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ঘুমের সমস্যা হয়েছে ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থীর, চোখের সমস্যা হয়েছে ৩৩ দশমিক ১ শতাংশের, অনিয়মিত খাদ্যাভাস হয়েছে ৩৮ দশমিক ২ শতাংশের, ঘাড়, হাত ও পিঠের ব্যথা হয়েছে ৪০ দশমিক ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর। ওজন বেড়েছে ৩০ দশমিক ৪ শতাংশের, পারিবারিক দূরত্ব বেড়েছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর এবং মাইগ্রেন এর ব্যথা হয়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর। দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে বসে থাকায় ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর মনোযোগ বা স্মৃতিশক্তি কমে গেছে।

জরিপের দেখা যায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এই সময়ে ৮৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একজন তরুণ শিক্ষার্থী যখন তার ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত হিসেবে পরিগণিত করে তখন তার বেঁচে থাকার স্পৃহা কমে যায়। যার উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ের আত্মহত্যার হার। শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনায় আত্মহত্যা বেড়েছে।'

তিনি বলেন, 'এই সমস্যা একপাক্ষিকভাবে সমাধান করা সম্ভব না। যেসব শিক্ষার্থী ঠিকমতো ঘুমাতে যায় না তাদের মাঝে বিষণ্ণতা বেশি। যারা অতিমাত্রায় ডিভাইস ব্যবহার করে তাদের ডিপ্রেশনের হার বেশি। একজন সচেতন ব্যক্তিই কিন্তু এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে নিজের ভালো একটা লাইফস্টাইল ঠিক করতে পারে। সঠিক সময়ে ঘুমানো ও শারীরিক ব্যায়াম করলে ডিপ্রেশন অনেকটাই কমবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের পরিবারগুলোকে গ্রুমিং করতে হবে। আমাদের বেশিরভাগ পরিবারের মাঝেই প্যারেন্টিংয়ের জ্ঞান সঠিকভাবে নেই। কখন সন্তানকে শাসন করতে হবে, কখন তাকে বুঝতে হবে সেই ব্যাপারগুলো অভিভাবকদের জানতে হবে। বর্তমানে সন্তান এবং পরিবারের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল থাকে যার ফলে শিক্ষার্থীরা নিজের মনের ব্যথাগুলো অভিভাবকদের কাছে শেয়ার করতে পারে না। এই জায়গায়ও আমাদের কাজ করার সুযোগ আছে।'

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইনোভেশন ফর ওয়েলবিং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান মনিরা রহমান টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবারের একটা লক্ষ্যই থাকে বিয়ে দেওয়া। অনেক পরিবার মনে করেছে করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ থাকায় তাদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে তাই বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো। তাছাড়া মহামারিতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে বন্ধন সেখানে অস্থিরতা দেখা গেছে। এর বেশিরভাগ প্রভাব পড়েছে নারীদের ওপর। তাই পুরুষদের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি দেখা দিয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ না থাকলে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করত। করোনার মধ্যে অনেকে স্বজন হারিয়েছেন। অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা, বয়স, স্বজন হারানো ইত্যাদির বিষয়গুলো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দায়ী। আর শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'অনেক অভিভাবক সন্তানদের কাছে অবাস্তব প্রত্যাশা করে থাকেন। তাছাড়া ছোটোবেলা থেকেই অনেক চাপে রাখেন। প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে অনেকেই মানসিক সমস্যায় ভোগেন। করোনা তাদের সেই সমস্যাকে আরও প্রকট করে দিয়েছে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহজাবিন হক টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনাকালে মানুষের জীবনযাত্রা থেমে গেছে। শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে তেমনভাবে মিশতে পারেনি, কথা বলতে পারেনি। তাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ,হতাশা, একাকিত্ব কাজ করেছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করেছে। অনেকে অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগেছেন। পরিবারের সব সদস্যদের বাড়ির মধ্যে একসঙ্গে বন্দি অবস্থার মতো জীবন যাপন করতে হয়েছে। এসব সমস্যার কারণেই শিক্ষার্থীদের মহামারির এই সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এই সমস্যা একদিনে সমাধান করা সম্ভব না। এখন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলছে তাই শিক্ষকদের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের চাপ না দিয়ে তাদের পাশে থাকা। তাদেরকে সময় দেওয়া। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখার জন্য বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেশি বেশি যোগাযোগ করা, একাকি না থাকা, সময় মতো খাওয়া-দাওয়া, ঘুমসহ মানসম্মত জীবনযাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

5h ago