তাপপ্রবাহ

‘এটা কেবল গরম লাগার বিষয় না, অবশ্যই দুর্যোগ’

তাপদাহ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে মুখে পানি ছিটাচ্ছেন এক ব্যক্তি। ছবিটি গত ১৬ এপ্রিল ঢাকা থেকে তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী এমরান হোসেন।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেসব স্থানে গত সাতদিন ধরে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা গত ৩০ বছরের একই সময়ের গড় তাপমাত্রার তুলনায় চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি—এমনটিই জানা গেছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য থেকে।

এ সময় প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে আর্দ্রতার কারণে শরীর জ্বালা করছে। বছরের এ সময়টাতে মাঝেমধ্যে কালবৈশাখী ও বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি আনলেও এবার তা নেই বললেই চলে। তীব্র তাপদাহে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক সপ্তাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।

উচ্চমাত্রার গরমের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় নানা ধরনের রোগবালাই বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে পানি-বিদ্যুতের সংকট। ফসলের উৎপাদন কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে খরা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুসারে, চলতি মাসের বাকি সময় ছাড়াও আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহ ধরে সারা দেশে থেমে থেমে তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অতি উষ্ণ ও আর্দ্রতার বিপদ থাকতে পারে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত।

এমন পরিস্থিতি করণীয় সম্পর্কে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারার সঙ্গে।

গওহার নঈম ওয়ারা। ছবি: সংগৃহীত

বিদ্যমান পরিস্থিতিকে 'দুর্যোগ' হিসেবেই দেখতে চান এই গবেষক। তার ভাষ্য, 'অবশ্যই এটা দুর্যোগ। একটা পরিস্থিতিকে কখন আমরা দুর্যোগ বলব? যখন কোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য অন্যের সহযোগিতা লাগে। বিষয়টা কেবল গরম লাগার না। এটার অর্থনৈতিক দিকও আছে। সেটা আমাদের মানতে হবে।'

এই লেখক বলেন, 'আমরা দুর্যোগ মাপি কেবল মানুষের মৃত্যু দিয়ে। মানুষ মারা গেলে তার সঙ্গে দুর্যোগের সম্পর্ক দেখি। সেটা ঠিক না। মানুষ না মরলেও অনেক বড় দুর্যোগ হতে পারে। দুর্যোগের যে আর্থ-সামাজিক ক্ষতি সেটা আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে এবং তা এখন ব্যাপকভাবে হচ্ছে। আমরা এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও দেখতে পাচ্ছি।'

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য এখনই জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন গওহার নঈম ওয়ারা। বলেন, 'যারা কৃষি করছেন, মাছ চাষ করছেন, যাদের হ্যাচারি আছে—সেগুলো প্রচণ্ড গরমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হ্যাচারিগুলো ঠিকমতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। বিদ্যুৎ রেশনিং হচ্ছে। এক্ষেত্রে যারা সেচকাজ করছেন, মাছ চাষ করছেন তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। গার্মেন্টসকে তো আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছিই। কিন্তু এর থেকেও বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে এই খাতগুলোকে। এই খাতগুলো বাঁচাতে হবে।

'যারা হ্যাচারি করছেন তারা এখন বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছেন শিল্প হিসেবে। আগে এটা কৃষির আওতাভুক্ত ছিল। ফলে এখন তাদের খরচ বেড়ে গেছে। এগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।'

প্রচণ্ড গরমে খামারিদের অনেক মুরগি মারা যাচ্ছে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'যারা মুরগির খামার করছেন তাদের বিষয়টাও দেখতে হবে। গরমে খামারে অনেক মুরগি মারা যাচ্ছে। ডিম পাড়া কমিয়ে দিচ্ছে। খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। এই বিষয়গুলো ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে অনেকটা সহজ করে আনতে পারি। হয়তো তা শতভাগ সফল হবে না। কিন্তু ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে। কারণ আমরা জানি সামনে আরও বেশি গরম অনুভূত হবে। বৈষম্যও বেড়ে যাবে।'

এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলায় জেলায় টাস্কফোর্স তৈরির তাগিদ দেন গওহার নঈম ওয়ারা। তার মতে, 'বিদ্যুৎ, কৃষি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে এক টেবিলে বসে কাজ করতে হবে।'

তাপপ্রবাহে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশেই রিকশা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন এক চালক। ছবিটি গতকাল ঢাকা থেকে তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী এমরান হোসেন।

পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের কৃষিতে এই তাপপ্রবাহের অভিঘাত কেমন, ক্ষতির পরিমাণ কতটা—এ বিষয়গুলো নিরূপণের তাগিদও দেন তিনি। বলেন, 'ঢাকা থেকে নির্দেশ না গেলে তো কেউ কোনো কাজ করেন না। কোনো কৃষিবিদই এখন বলতে পারছেন না যে এই তাপদাহের কারণে কৃষির কতটা লোকসান হচ্ছে, মৌমাছির কতটা ক্ষতি হচ্ছে। এগুলো জানতে হবে।'

এ ছাড়া গরমের কারণে ঢালাওভাবে দেশের সব স্কুল একসঙ্গে বন্ধ করে দেওয়ার সমালোচনাও করেন এই লেখক। বলেন, 'গরমের কারণে আমরা স্কুল বন্ধ করে দিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু সারাদেশে তো এত গরম পড়ছে না। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি কিংবা পঞ্চগড়ের চিত্র তো একরকম না। তাহলে সেখানকার স্কুল কেন বন্ধ থাকবে। এগুলো সবই বৈষম্যমূলক আচরণ। এতে আমাদের ক্ষতি আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জেলাভিত্তিতে, এলাকাভিত্তিতে, অববাহিকাভিত্তিতে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার কাজ করতে হবে।'

তা ছাড়া কৃষি বিভাগেরই এখন জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করা উচিত মন্তব্য করে এই গবেষক আরও বলেন, 'বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো কৃষি কর্মকর্তাকেই আমি গরমের কারণে মাঠে যেতে দেখিনি। তাদের তো রাখাই হয়েছে গরম-বৃষ্টির ভেতর কাজ করার জন্য। এখন ঢাকা থেকে নির্দেশ যাওয়া উচিত যে—তোমরা মাঠে যাও। কৃষকের সঙ্গে কথা বলো। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে জানাও। সরকার কারও কাছ থেকে তো এটা জানতেও চায়নি।'

গওহার নঈম ওয়ারার ভাষ্য, 'আমাদের সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় গরম পড়লে পঞ্চগড়ে স্কুল বন্ধ হয়। কিন্তু এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে সেটা আমরা জানি না। একবার পড়াশোনায় ছেদ পড়লে সেখান থেকে ফিরে আসা যে কতটা কঠিন তা করোনা মহামারির সময় দেখেছি। সে সময় মাদরাসা বন্ধ করতে পারেনি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বন্ধ করতে পারেনি। সাধারণ শিক্ষা বন্ধ হয়েছে। গরিবের শিক্ষা বন্ধ হয়েছে। তাদের অনেকে আর ফিরে আসেনি।

'এই গরমের ভেতরেও কীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা যায়, কোন সময়ে কীভাবে স্কুল চালু রাখলে শিক্ষার্থীদের কষ্ট হবে না, তা বের করতে হবে। বন্ধ করে দেওয়া সমাধান না। স্কুলের টিউবওয়েলে যেন পানি ওঠে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক জেলার পরিস্থিতি তো একইরকম না। প্রত্যেক জেলার জন্য পরিস্থিতি অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে। হাসপাতালগুলোর জন্য আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলায় জেলায় সর্বদলীয় কমিটি করে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

‘I couldn’t miss it’: White wave engulfs National Stadium

With more than three hours to go before kick-off in the highly-anticipated Asian Cup Qualifier between Bangladesh and Singapore, the newly renovated National Stadium is already transforming into a sea of white -- the colour of Bangladesh's home jersey.

48m ago