অনিদ্রার কারণ ও প্রতিকার

ছবি: অর্কিড চাকমা

একজন মানুষের সুস্থ থাকার অন্যতম নিয়ামক হলো ঘুম। স্বাভাবিক প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমালে তা স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে। তবে বয়স অনুযায়ী শরীরে ঘুমের চাহিদা ভিন্ন হয়।

সাধারণত পূর্ণবয়স্ক মানুষদের ৭-৮ ঘণ্টা, শিশুদের ৯-১৩ ঘণ্টা, নবজাতক বাচ্চাদের ১২-১৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমানোর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, টক্সিন নামক পদার্থ শরীর থেকে বের করে দিয়ে কর্মক্ষমতাও বাড়ে। সুতরাং পরবর্তী দিনের শক্তি ও দক্ষতার অনেকটাই নির্ভর করে ব্যক্তির পর্যাপ্ত ঘুমের ওপর।

রাতে ঘুম না আসা বা আসলেও বারবার ভেঙ্গে যাওয়াকে বলা হয় ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগ। যার ফলে দিনের বেলা ঘুমোনো, সারাদিন ঝিমুনি ভাব, কাজে মনোযোগ না দিতে পারা, সারাদিন মেজাজ খিটখিটে ও বিষণ্ণ হয়ে থাকার মত ঘটনা ঘটতে পারে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবারই ইনসমনিয়া হতে পারে। তবে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের হার কমে যাওয়া বা ঘুম পাতলা হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির কারণে ইনসমনিয়ার ভুক্তভোগী। এই সমস্যা এখন এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে অনিদ্রাকে দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করে ফেলছে কেউ কেউ।

অধ্যাপক ওয়াকার 'হোয়াই উই স্লিপ' বইয়ে লিখেছেন, 'বিশ্বের একটা বিশাল অংশ অন্ধকারে জেগে থাকে। যে ঘুম তাদের নষ্ট হচ্ছে, সেটা যে পূরণ করা দরকার, সেটা তারা ভাবে না। তারা মনে করে, 'যা গেছে তা গেছে।'

অনিদ্রা স্বাস্থ্যের যা ক্ষতি করে

ঘুম কম হওয়া বা ঘুমের সমস্যার কারণে ব্যক্তি শারীরিকভাবে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়। এ পর্যন্ত ১৫৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ওজন বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। জার্নাল সায়েন্সের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, অনিদ্রার সঙ্গে দ্রুত মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু অন্যান্য অসুখ যেমন ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশতা এবং ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার সঙ্গে ইনসমনিয়ার যোগসূত্র রয়েছে।

এক গবেষণা বলছে, কেউ টানা ১৭ থেকে ১৯ ঘণ্টা জেগে থাকলে মস্তিষ্কে যে ধরনের প্রভাব পড়ে, অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলেও একই ধরনের প্রভাব পড়ে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। গবেষণায় বলছে, কোনো ব্যক্তি যদি টানা ১১ দিন না ঘুমিয়ে থাকে, এতে স্বাভাবিক আচরণ ও দৈনন্দিন কাজেকর্মে মারাত্মক প্রভাব পড়ে যা তাকে শর্ট টাইম মেমোরি লস থেকে শুরু করে হেলুসিনেশন, এমনকি মস্তিষ্ক বিকৃতির দিকেও নিয়ে যেতে পারে।

অনিদ্রা দূর করার উপায়

অনেকে ঘুমের সমস্যা দূর করতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে থাকেন। এটি স্বাস্থ্যকে আরও ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়। স্লিপিং পিল বা ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমানোর প্রবণতা, একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়। যার ফলে স্লিপিং পিল সেবন না করলে স্বাভাবিকভাবে আর ঘুম আসে না।

অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করতে পারে। এটি মানুষের হার্ট ও ব্রেনের রক্তনালীর রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। অনেকসময় অতিরিক্তি ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে। অনিদ্রা দূর করার একমাত্র উপায়ই হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম।

চলুন দেখে নিই ঘুমের সমস্যা দূর করার কয়েকটি ঘরোয়া উপায়-

রাত জেগে কাজ না করা

যারা রাত জেগে কাজ করেন তারা অনেক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় পড়েন। রাতে কাজ করে তারা দিনে ঘুমিয়ে রাতের ঘুমের অভাব পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কারণ সাধারণত তারা দিনের বেলার ঘুম কখনোই তেমন গভীর হয় না এবং তা রাতের ঘুমের সুফল দিতে পারে না শরীরকে। হার্ভাডের এক গবেষণা বলছে, রাতে কাজ করা লোকজনের অনেকেই নিশাচর হয়ে যান। তারা কিছুতেই দিনের আলোয় বের হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।

প্রতিদিন একই সময় ঘুমোতে যাওয়া

প্রতিদিন রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে এবং সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিছানা জেগে উঠতে হবে। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা ঘুমানোর সময়কালকে নিয়মিত রাখে এবং শরীরও সময়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারে।

চা-কফি থেকে দূরে থাকা

চা-কফি খেলে অনেকেরই ঘুমের সমস্যা হয়৷ শুধু চা-কফি নয় যেকোনো কোমল পানীয়ও ঘুমের সমস্যার কারণ হতে পারে। প্রফেসর ওয়াকার বলছেন, ঘুমানোর সময়ে থেকে ১২ ঘণ্টা আগে এসব খাওয়া বন্ধ করা উচিত। কেননা এর প্রভাব শরীরে থেকে যায় দীর্ঘ সময়।

দূরে রাখুন ফোন ল্যাপটপ

আমরা অনেকেই বিশ্রাম নিতে কিংবা ঘুমের আগে ফেসবুক থেকে ঢু মেরে আসি। কিন্তু এতে ঘুম আসার পরিবর্তে মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়ে দেয়। তাই ঘুমের সমস্যা দূর করতে চাইলে দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।

খাদ্যাভ্যাস

আমরা অনেকেই জানিনা, ঘুমের সমস্যার পেছনে খাদ্যাভাসের ভূমিকা অনেক। যারা ইনসমনিয়ায় ভুগছেন তাদের জন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা ঘুমের জন্য সহায়ক হতে পারে।

ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার

ম্যাগনেসিয়াম হলো এমন একটি খনিজ পদার্থ যা পেশীকে শিথিল করতে এবং স্ট্রেস কম করতে সাহায্য করে। ডার্ক চকোলেট, বাদাম, অ্যাভোকাডো এগুলোতে ম্যাগনেসিয়াম আছে। রাতে এগুলো খেলে ভালো উপকার পাবেন।

মেলাটোনিনযুক্ত খাবার

মেলাটোনিন শুধু ঘুম আসতে নয়, ঘুম দীর্ঘস্থায়ী করতেও সাহায্য করে। আমরা সালাদ হিসেবে যা খাই যেমন টমেটো, শসা, ব্রোকোলি, সরিষা, আখরোট, বেদানা ইত্যাদিতে মেলাটোনিন থাকে। প্রতিদিনের খাবারে সবজিগুলো যোগ করলে ঘুমের সমস্যা কেটে যাবে৷

কলা

অনিদ্রা কমাতে কলা খুবই কার্যকর৷ কলাতে আছে ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম যা মাংসপেশি শিথিল করে দ্রুত ঘুম আনয়নে সাহায্য করে৷

গরম দুধ

অনিদ্রা দূর করতে গরম দুধের কোনো বিকল্প নেই। গরম দুধে থাকে ট্রিপটোফ্যান নামে এক ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড। যা সিরোটোনিন হিসেবে কাজ করে আর এই সিরোটোনিন ঘুম আনতে খুবই সহায়ক।

মধু

মধুকে বলা হয় সর্বরোগের মহৌষধ। এক চামচ মধু ভালো ঘুমের জন্য খুবই সহায়ক কেননা এটি শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী হরমোন কমাতেও মধুর জুড়ি নেই।

তথ্যসূত্র:

 ১. বিবিসি

Comments

The Daily Star  | English

Over 102,000 annual deaths in Bangladesh linked to air pollution

Study also finds air pollution behind 266 million sick days every year hurting the economy

1h ago