তাসমিত আফিয়াত অর্নি: বিশ্ববাজারে জামদানির নতুন পরিচয় দিচ্ছেন যিনি

ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বিয়ের পোশাক হিসেবে জামদানির ব্যবহারে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন তাসমিত আফিয়াত অর্নি। উৎপাদন সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকার পরেও নিজের সাংস্কৃতিক জ্ঞান এবং টেকসই পদ্ধতির ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জামদানির প্রসার ঘটিয়েছেন। তার এসব প্রচেষ্টা জামদানিকে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন বাজারে একটি বিলাসবহুল ও আকর্ষণীয় কাপড়ে পরিণত করছে।
জামদানি কেবল একটি কাপড় নয়, অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে বুনে যাওয়া সূক্ষ্ম কারুশিল্প। জামদানি বোনা খুব পরিশ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এটি ব্যাপকভাবে উৎপাদন সম্ভব নয়। আর তাই আধুনিক বিশ্বের ফাস্ট ফ্যাশন ও ব্যাপকহারে উৎপাদন হওয়া পোশাকের মধ্যে টিকে থাকতে জামদানিকে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে।
আধুনিক ফ্যাশন জগতে টিকে থেকে বিকশিত হতে চাইলে জামদানিকে অবশ্যই তার স্বকীয়তা বজায় রেখেই এগিয়ে যেতে হবে। আর এই চ্যালেঞ্জটাই নিয়েছেন স্ট্রাইড ফ্যাশন ওয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা, প্রধান নির্বাহী এবং ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আসমিত আফিয়াত অর্নি। তার নতুন ওয়েডিং কালেকশন 'সেরেনোভা'র মাধ্যমে শুরু হয়েছে সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের কাজ।
বিয়ের পোশাকের জন্য দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানিয়াল এলএলসি পরিচালিত স্ট্রাইড ফ্যাশন ওয়্যার ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশি কাপড়কে আধুনিক ও বিলাসবহুল ফ্যাশনের পোশাকে রূপান্তর করতে কাজ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এক্ষেত্রে অর্নির দৃষ্টিভঙ্গি ভীষণ বাস্তবসম্মত এবং বাজারের চাহিদাভিত্তিক।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অর্নি বলেন, 'আমরা যখন জামদানি নিয়ে কাজ করি তখন সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় পড়ি সেটা হলো, প্রায় সময়ই মনে হয় আমরাই বুঝি গ্রাহককে জোর করে জামদানি পরাচ্ছি। অথচ কাপড়ের গুণেই এটির প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়ার কথা ছিল! আমি ঠিক এই চ্যালেঞ্জটিই নিলাম। আমি জামদানি দিয়ে এমন কিছু তৈরি করতে চেয়েছিলাম যা গ্রাহকরা আগে থেকেই পছন্দ করেন বা যা তারা পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেই ভাবনা থেকেই বিয়ের গাউন তৈরি করি। যেটি যেমন বিয়ের কনের সৌন্দর্যকে আকর্ষণীয় করে তুলবে, তেমনি বিশেষ দিনের জন্য হবে সবার চেয়ে অনন্য পোশাক।'
সেরেনোভা নামের এই বিশেষ সংগ্রহে রয়েছে নরম, ছায়া-ছায়া সাদা রঙের পোশাক, যে রংটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ডাস্কি হোয়াউট। এই রং বেছে নেওয়ার কারণ হলো, রংটি বিয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ প্রশান্তি এবং নতুন জীবন শুরুর প্রতীক।
সেরেনোভা শব্দটি তৈরি হয়েছে সেরেনা আর ভিভা শব্দ দুটির মেলবন্ধনে। এখানে সেরেনা অর্থ নির্মলতা বা প্রশান্তি এবং ভিভা শব্দের অর্থ নতুন সূচনা; যা সুরুচি ও সাংস্কৃতিক গভীরতার প্রতীক। আধুনিকতার সঙ্গে প্রাচীন কারুশিল্পের চমৎকার সংমিশ্রণের মাধ্যমে সেরেনোভা সেইসব বর-কনেদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, যারা স্টাইলের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যকেও পোশাকে ধরে রাখতে চান।
উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা
জামদানির প্রতি বিশেষ দুর্বলতা থাকার পরেও যেহেতু এটি বুনতে অনেক বেশি সময় লাগে, তাই বিয়ের পোশাক হিসেবে এর ব্যবহার কঠিন ছিল।
এ প্রসঙ্গে অর্নি বলেন, 'এই শিল্পে সবসময়ই নতুন পণ্যের চাহিদা বেশি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছি তা হলো সময়। ভালো মানের জামদানি বুনতে অনেক বেশি সময় লাগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এত সময় অপেক্ষা করার ধৈর্য গ্রাহকের থাকে না। তাদের দ্রুত পোশাক প্রয়োজন হয়। কিন্তু সত্যি কথা হলো, একা এত দ্রুত কাজ করা সম্ভব নয়।'

এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে জামদানির নকশা বিষয়ে গভীর চেনাজানা করতে হয়েছে অর্নিকে।
তিনি বলেন, 'যদি আমাকে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে হয় তাহলে প্রতিটি নকশা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতে হবে। পুনরাবৃত্তি যেকোনো কাজকে সহজ করে তোলে। তাই একবার কোনও একটি নকশার সঙ্গে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলে এরপর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি সেই কাজে ফিরে যেতে পারি।'
বিশ্বজুড়ে উপস্থিতি জানান দেওয়া
স্ট্রাইড ফ্যাশন ওয়্যারের ঝুলিতে রয়েছে বেশকিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সাংহাইতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন উইকে অংশ নেওয়ার পর চীনের সঙ্গে ১০ বছরের একটি চুক্তি হয়েছে। যার অর্থ হলো এই অঞ্চলের মানুষের বিলাসবহুল টেকসই ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
অর্নি বলেন, `একই সঙ্গে এই বাজারের ক্রেতারা যুক্তরাষ্ট্রের মানসম্পন্ন পণ্যের জন্য বেশি অর্থও ব্যয় করতে ইচ্ছুক হয়ে উঠছেন। আমি এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছি। তার মানে এই নয় যে আমি তাদের কাজকে ছোট করছি, আমি কেবল নিজের কাজটিকে তুলে ধরছি।'
চীনের এই সফলতার পর মিয়ামি ফ্যাশন উইকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে স্ট্রাইড ফ্যাশন। যার মাধ্যমে জামদানি ব্যবহার করে উচ্চমানের বিয়ের পোশাককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়।
`আমার মূল লক্ষ্য হলো বিশ্ববাজারে জামদানিকে একটি জনপ্রিয় কাপড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমি এরই মধ্যে জামদানির দারুণ চাহিদা দেখতে পাচ্ছি। আমার বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের অধিবাসী। যখনই আমি একটি নতুন নকশার ছবি আপলোড করি, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নতুন অর্ডার পাই। সবশেষ নতুন পোশাকের ছবি আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০টি অর্ডার পেয়েছি', যোগ করেন অর্নি।

সংস্কৃতিতে কাপড়ের যে ভিন্নতা, সে সম্পর্কে অর্নি ভীষণ সচেতন। আর তাই তো এ সম্পর্কিত শিক্ষাও তার কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, `এই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে জ্ঞানের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। যেমন মাটি, সিরামিক বা ধাতুর তৈরি জিনিসপত্র আলাদা হয় তেমনি কাপড়ের ক্ষেত্রেও তাই। আমরা ডিজাইনাররা এই পার্থক্য বুঝতে পারি, কারণ এটা আমাদের কাজেরই অংশ। বিষয়টি জামদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জামদানির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু এটি তৈরি করা এখনও অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ বলে মনে করা হয়। এজন্যই আমাদের বুননের দক্ষতা ও নকশা তৈরির দক্ষতা বাড়াতে হবে।'
সমসাময়িক রুচির সঙ্গে মানানসই জামদানিভিত্তিক পোশাকের নকশার ক্ষেত্রে অর্নির লক্ষ্য হলো, পোশাকটি যেন বিলাসবহুল পণ্যের বদলে বিশ্বব্যাপী ফ্যাশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে সেদিকে নজর দেওয়া।
টেকসই উন্নয়নের প্রতি অঙ্গীকার
বৈশ্বিক ফ্যাশনে অর্নির শুরুটা হয়েছিল রিকশাচিত্র অনুপ্রাণিত জ্যাকেট তৈরির মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছ থেকে যার অপ্রত্যাশিত সাড়া পান তিনি।
সেই সময়ের কথা মনে করে অর্নি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমার প্রথম যে পণ্যের প্রবেশ ঘটে সেটি হলো রিকশা পেইন্ট করা জ্যাকেট। একজন বিদেশি গ্রাহক জ্যাকেটটি কিনেছিলেন, যদিও সেটিতে বাংলাদেশের কিছু অতি প্রচলিত গালি লেখা ছিল। কিন্তু সে বিষয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি বলেছিলেন, ''এখানে কী লেখা আছে তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি শুধু এই রঙিন নকশাগুলো পছন্দি করি!'' আর সেই মুহূর্তেই আমি দেখতে পেয়েছিলাম বিশ্ববাজারে আমাদের ঐতিহ্যবাহী নকশার শক্তি।'
এই অভিজ্ঞতা অর্নির বিশ্বাসকে আর্র দৃঢ় করে তোলে যে, যদি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড়কে সঠিক উপায়ে বিশ্ববাজারের ভোক্তাদের কাছে তুলে ধরা যায় তাহলে সবার কাছেই এটি জনপ্রিয় হবে।
ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সেতুবন্ধন ঘটিয়ে তাসমিত আফিয়াত অর্নির মতো ডিজাইনার এবং শিল্পখাতের নেতারা বিশ্বব্যাপী জামদানির নতুন ধারণার প্রবর্তন করতে পারেন। যার মাধ্যমে এটি পুরোনো দিনের কাপড়ের তুলনায় বরং আধুনিক যুগের অপরিহার্য কাপড়ে পরিণত হতে পারে।
ছবি: শাহনেওয়াজ অনিক
মডেল: ফাবলিহা খান, নিশাত তাসনিম আনিকা, করডে ইন্নিস
পোশাক: স্ট্রাইড
স্টাইলিং ও নির্দেশনা: তাসনিম আফিয়ান অর্নি
মেকওভার: রিপন মিয়া
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments