ফ্যাশনের নিয়ম নতুন করে লিখেছেন যিনি: আজরা মাহমুদের সঙ্গে কথোপকথন

আজরা মাহমুদ
আজরা মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

আজরা মাহমুদ। বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তার সঙ্গে আলাপে উঠে এল এই ইন্ডাস্ট্রিতে তার যাত্রা, কাজ, ফ্যাশন ট্রেন্ড এবং খাতসংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলোর কথা। তিনি জোর দিলেন ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, অন্তর্ভুক্তি এবং উদ্যমের ওপর। উন্নত ব্যবস্থাপনা আর যথাযথ স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশ যে ভবিষ্যতে গ্লোবাল ফ্যাশন হাবে পরিণত হতে পারে, সে প্রত্যাশার কথাও জানালেন।

আজরা মাহমুদকে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির একজন পথিকৃৎ। যিনি একাধারে মডেল, কোরিওগ্রাফার, মেন্টর এবং ফ্যাশন শোয়ের পরিচালকও। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এই শিল্পে কাজ করছেন তিনি। এই সময় তিনি কেবল মঞ্চেই রাজত্ব করেননি, পর্দার আড়াল থেকে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে যথাযথ আকার দিতেও কাজ করেছেন। 

তার প্রতিষ্ঠিত আজরা মাহমুদ ট্যালেন্ট ক্যাম্পে (এএমটিসি) নতুন প্রজন্মের মডেলদের গ্রুমিং করা হয়, তারা যেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অংশ নিতে পারেন সে অনুযায়ী তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়।

স্টার লাইফস্টাইলের সঙ্গে আলাপচারিতায় সম্প্রতি উঠে এলো ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে আজরা মাহমুদের যাত্রা, বাংলাদেশের ফ্যাশন জগতের পরিবর্তন এবং সদা পরিবর্তনশীল এই খাতটিতে সফল হতে আসলে কী কী করা প্রয়োজন; সেসব প্রসঙ্গ।

স্টার লাইফস্টাইল: আপনি তো মডেল, কোরিওগ্রাফার, উপস্থাপন, মেন্টর নানা ভূমিকায় কাজ করেছেন। এর মধ্যে কোন চরিত্রটিকে সবচেয়ে নিজের বলে মনে হয়?

আজরা মাহমুদ: হ্যাঁ, আমি অনেক ভূমিকায় কাজ করেছি। মডেল, উপস্থাপক, কোরিওগ্রাফার, স্টাইলিস্ট, মেন্টর, উদ্যোক্তা এবং অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। এমনকি ডাবিং শিল্পী হিসেবেও কাজ করেছি। তবে এর মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার চেয়ে আমি বলব, ফ্যাশনই আমাকে সংজ্ঞায়িত করে। সেটা র‌্যাম্পের মঞ্চে হতে পারে, আবার পর্দার আড়ালেও হতে পারে। ফ্যাশনের প্রতি আমার আসক্তি সবসময়ই অবিচল। ঠিক কোনো চরিত্রে বা ভূমিকায় আমাকে মাপতে পারবেন না, ফ্যাশনের জগতটাই আমাকে ক্রমাগত আকর্ষণ করে চলে।

স্টার লাইফস্টাইল: এএমটিসির মাধ্যমে আপনি অনেক উদীয়মান মডেলকে গ্রুম করেছেন,পরামর্শ দিয়েছেন। প্রতিটি সফল মডেলের মধ্যে কোন গুণটি অবশ্যই থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আজরা মাহমুদ: আগের তুলনায় মডেলিং ইন্ডাস্ট্রি এখন অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক। অনেক নতুন এজেন্সি হয়েছে, নতুন নতুন ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে অন্তত ১০০ মডেল এখন এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করছে। এই পরিস্থিতিতে এই শিল্পে টিকে থাকার এবং নিজেকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো ক্রমাগত নিজের বিকাশ ঘটানো এবং উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা।

যে মডেল তার কাজে উন্নয়ন ঘটাতে পারে না বা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে পরিমার্জন করতে শেখে না, ধীরে ধীরে সে এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে ঝরে পরে। এখানে ভালো করতে হলে ক্রমাগত শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে হবে। যদি একজন মডেল তার হাঁটা, অভিব্যক্তি, অভিযোজন ক্ষমতা বা পেশাদারত্বের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ না করে তাহলে সে যেই হোক না কেন, তাকে এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে হারিয়ে যেতে হবে। তাই একজন সফল মডেল হলেন তিনি, যিনি বৃহত্তর চিত্রটি দেখতে পান, ক্রমাগত নিজেকে বিকশিত করতে থাকেন এবং সবসময় নতুন কিছু শেখার বিষয়ে আগ্রহী থাকেন।

স্টার লাইফস্টাইল: আপনারা যখন শুরু করেছিলেন তার পর থেকে বাংলাদেশের ফ্যাশন জগত কীভাবে বিকশিত হয়েছে, এখনও কীসের অভাব রয়েছে এখানে?

আজরা মাহমুদ: আমি ২০০১ সালে কাজ শুরু করেছিলাম। তখন বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অনেক ছোট ছিল। হাতে গোনা কয়েকজন ডিজাইনার, মডেল আর কয়েকটি ইভেন্ট নিয়ে চলত এই জগত। এই ইভেন্টগুলোও আয়োজিত হতো মূলত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে।

২৪ বছর পর এসে এখন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বড় হয়েছে। নতুন নতুন ব্রান্ড যুক্ত হয়েছে, নতুন ডিজাইনাররা কাজ করছেন, তাদের সংগঠন হয়েছে, অনেক ফ্যাশন উইক পরিচালিত হচ্ছে। এসবই অনেক সুযোগ তৈরি করছে। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা এখনও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। যথাযথ পরিকল্পনা, ব্রান্ডিং, অর্থায়ন এবং নতুন প্রতিভাকে সুযোগ দেওয়ার একটি সমন্বিত ব্যবস্থা ছাড়া এই খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধি হওয়া কঠিন।

তাছাড়া, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে ফ্যাশন হাবের বদলে উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। আমরা 'মেইড ইন বাংলাদেশ' স্লোগানের ওপর জোর দিয়েছি, 'ডিজাইনড ইন বাংলাদেশ' এর ওর সেই পরিমাণ জোর দিইনি। যা বিশ্বজুড়ে আমাদের পরিচিতিকে বরং কিছুটা সীমিতই করেছে। যদিও এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে, তবে এখনও অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি।

স্টার লাইফস্টাইল: অনেক সময়ই ফ্যাশন সৌন্দর্যের মানদণ্ড ঠিক করে দেয়। আপনাকে কী কখনও এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে? অন্যরা যদি এ সম্পর্কিত সমস্যায় পড়ে তাহলে আপনি কীভাবে তা সমাধানে তাদের সাহায্য করেন?

আজরা মাহমুদ: আজকাল অনেকেই ফ্যাশনে অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। আমার কাছে এটিকে প্রতীকী প্রচেষ্টার মতো মনে হয়। প্লাস সাইজের বা অপ্রচলিত মডেলকে নিয়ে কাজ করানোই প্রকৃত অর্থে বৈচিত্র্য নয়। আমি যখন শুরু করেছিলাম তখন বেশিরভাগ গ্রাহকই ফর্সা ত্বকের মডেল পছন্দ করতেন। অথচ আমাদের দেশের মানুষের গায়ের রং বিবেচনায় নিলে তা অযৌক্তিক। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, গায়ের রঙের প্রতি এই পক্ষপাত এখনও বিদ্যমান।

সৌন্দর্যের মানদণ্ড আসলে এক ধরনের রাজনৈতিক ধারণা, যা ক্ষমতাশালীরা ঠিক করে দেয়। ঐতিহাসিকভাবেই বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রভাবশালীরাই সৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করে আসছে। যেমন বর্তমানের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ বেশি, তাই সৌন্দর্যের মানদণ্ডের ক্ষেত্রে মেনে চলা হয় ইউরোপকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো।

একজন মেন্টর ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী হিসেবে কেবল গায়ের রং বা শরীরের গঠন দেখে মডেল নির্বাচনের পক্ষপাতী নই। বরং প্রতিভা, মঞ্চে উপস্থিতি এবং আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে মডেল নির্বাচনকেই আমি সঠিক মনে করি। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, সৌন্দর্যের সামাজিক মানদণ্ডকে ছাপিয়ে মডেলরা তাদের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। এই খাতটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু সত্যিকারের অন্তর্ভূক্তিমূলক খাত গড়ে তুলতে গেলে আমাদের আরও বেশি উদারমনা ডিসিশন মেকারের প্রয়োজন হবে।

স্টার লাইফস্টাইল: নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে কী আপনাকে অনুপ্রেরণা দেয়?

আজরা মাহমুদ: শুরু থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল বিশ্বমানের ফ্যাশন প্রযোজনাগুলো বাংলাদেশে নিয়ে আসা। আমার মনে আছে, ফ্যাশন টিভি (এফটিভি) দেখতাম এবং আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন দেখে মুগ্ধ হতাম। আমি তখন ভাবতাম যে, নিজের উচ্চতা নিয়ে হয়তো মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছতে পারব না, কিন্তু সুযোগ পেলে এই মানের অনুষ্ঠান ঠিকই তৈরি করতে পারব।

এই স্বপ্ন আমাকে বছরের পর বছর ধরে তাড়া করছে। আমি আরও বড় ও উন্নত প্রযোজনার জন্য কাজ করেছি, ফ্যাশন শোকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে পেশাদারত্ব সৃষ্টি করতে কাজ করেছি। আমি বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের প্রতিভা আছে। এই প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য আমাদের কেবল সঠিক প্লাটফর্মের প্রয়োজন।

আমি এখনও সেখানে পৌঁছাইনি, কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছে গেছি বলেই মনে করি। আর যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে উন্নত করার সুযোগ আমার সামনে থাকবে, আমি সেদিকে এগিয়ে যাব। কারণ যখনই সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে, আমি কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। উন্নতির পথে যাত্রাই আমাকে প্রেরণা দেয়, কাজে উৎসাহ যোগায়।

স্টার লাইফস্টাইল: উদীয়মান মডেলদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

আজরা মাহমুদ: এখনকার প্রজন্ম তাৎক্ষণিক ফলাফল চায়। তারা রাতারাতি সাফল্য অর্জন করতে চায়। কিন্তু সত্যিটা হলো প্রকৃত সাফল্য পেতে হলে সময় লাগে। যদি কোনো কিছু খুব সহজেই ধরা দেয় তাহলে আপনি তার সত্যিকার মর্ম উপলব্ধি করতে পারবেন না এবং সহজে ধরা দেওয়া সাফল্য দীর্ঘস্থায়ীও হয় না।

সাফল্যের চাবিকাঠি হলো, কঠোর পরিশ্রম করা এবং ধৈর্য ধরে লেগে থাকা। আপনি যদি চেষ্টা চালিয়ে যান, এই শিল্পের নৈপুণ্য অর্জন করেন এবং নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর নজর দেন তাহলে যে সফলতা পাবেন তা আপনার জন্য যেমন অর্থবহ হবে, তেমনি টেকসইও হবে।

এছাড়া সহনশীলতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেশ কঠিন জায়গা। এখানে সমালোচনা থাকবে, প্রত্যাখ্যান থাকবে এবং নানা ধরনের বাধা-বিপত্তিও থাকবে। কিন্তু আপনি যদি নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকেন এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন, তাহলে দিনশেষে সাফল্য আপনার ঝুলিতে ধরা দেবেই।

স্টার লাইফস্টাইল: আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে বিকশিত হবে বলে আপনি মনে করেন?

আজরা মাহমুদ: বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো, অনেকেই এই শিল্পকে বা এই পেশাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন না। এটিকে খুব হালকাভাবে নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফ্যাশন দৈনন্দিন জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। প্রতিদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আপনি প্রথমেই যা করেন তা হলো পোশাক পরা। আর সেটিই হলো ফ্যাশন। এটি একটি অপরিহার্য শিল্প। অথচ এখনও এই শিল্প তার প্রাপ্য গুরুত্ব বা সহায়তা পায় না।

প্রকৃত প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের যথাযথ সমর্থন, বিনিয়োগ এবং সঠিক সমন্বয় প্রয়োজন। এই মুহূর্তে সবাই যার যার জায়গা থেকে শিল্পটিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা।

এত ধরনের চ্যালেঞ্জের পরেও আমি বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ক্রমেই এগিয়ে যাবে। আরও ডিজাইনার, ব্র্যান্ড এবং প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব ঘটবে এবং একটা সময়ে গিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি স্বীকৃত ফ্যাশন হাব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
Apparel Buyers Delay Price Increases Post-Wage Hike Promise

Garment exports to US grow 17%

Bangladesh shipped apparels worth $5.74 billion in the July-March period to the USA

3h ago