পিনন হাদি: ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেল
পিনন হাদি হলো ঐতিহ্যবাহী একটি পোশাক। একটি মাত্র কাপড়ের টুকরো থেকে বিবর্তিত হতে হতে যেখানে যুক্ত হয়েছে আধুনিক এম্বয়ডারিও। কোমর তাঁতে বোনা পিনন হাদি যেমন ঐতিহ্যবাহী, তেমনি টেকসই। এর সঙ্গে সমসাময়িক নান্দনিকতা যুক্ত হয়ে বিয়ের পোশাক হিসেবেও পিনন হাদিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
দীর্ঘদিন ধরেই পিনন হাদি একটি সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। সাধারণত নারীরা এটি বুকের চারপাশে বাঁধতেন, যা একই সঙ্গে ব্লাউজ ও শরীরের ঊর্ধ্বাংশের পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে সময়ের সঙ্গে এবং বাইরের সংস্কৃতির প্রভাবে পিনন হাদির সঙ্গে আলাদা ব্লাউজের প্রচলন হয়। পিনন হাদির স্বকীয়তা নষ্ট না করে বরং এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে এটি। ব্লাউজের সঙ্গে পিনন হাদি এত চমৎকার সঙ্গে মানিয়ে গেছে যে, আধুনিক ডিজাইনাররা দুটোকে মিলিয়েই ডিজাইন করেন। এক্ষেত্রে তারা শাড়ির বিবর্তনের কথা স্মরণ করেন, কারণ শুরুতে শাড়িও কেবল একখণ্ড কাপড় হিসেবেই পরা হতো।
পিনন হাদি তৈরি বা বুননের প্রক্রিয়া বেশ জটিল। প্রতিটি পিনন হাদি ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁতে বোনা হয়, এর প্রতিটি টুকরোই পুরোপুরি হাতে তৈরি। এই কাপড় তৈরি কেবল শ্রমসাধ্যই নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ দক্ষতারও। যত ভালো বুনন হবে, কাপড়টি তত হয়ে উঠবে দামী, সেইসঙ্গে টেকসইও।
বৈচিত্র্য আর ঐতিহ্যের মিশেলে তৈরি পিনন হাদি তার সাংস্কৃতিক সীমানার বাইরেও বহুদূর ছড়িয়ে পড়েছে। এখন স্থানীয় অনেক বিয়েতেও এটি বেছে নিচ্ছেন কনেরা।
এর কারণ হিসেবে ফ্যাশন ডিজাইনার তেনজিং চাকমা মনে করেন, এখন অনেক কিছুই অনেক সহজ হয়ে গেছে। যেমন পিনন হাদি তৈরির যে ঐহিত্যবাহী সুতা তার বদলে চাইলেই আমদানি করা সুতা ব্যবহার করা যায়, কারণ এটি সহজলভ্য। আবার এটি ব্যবহার করলে পোশাকটি তুলনামূলক সুলভ হয়, একই সঙ্গে স্বকীয়তায় কিছুটা পরিবর্তনও আসে।
তেনজিং বলেন, 'আমি যখন প্রথম কাজ শুরু করি, তখন খুব কম কনেকেই বিয়ের পোশাক হিসেবে পিনন হাদি বেছে নিতে দেখতাম। তাই আমি এই পোশাকটির প্রতি সাধারণ মানুষের মনোযোগ ফেরাতে চেষ্টা করেছি, এটিকে জনপ্রিয় করতে চেষ্টা করেছি।'
তেনজিং চাকমার কঠোর পরিশ্রমকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। সেইসঙ্গে মানুষের নতুন কিছু পরার আকাঙ্ক্ষাকেও ধন্যবাদ। এ দুইয়ে মিশেলে তৈরি হয়েছে বিয়ে এবং গায়ের হলুদের জন্য ভীষণ অভিজাত কিন্তু ঐতিহ্যবাহী পোশাক।
তেনজিং বলেন, 'ধীরে ধীরে আমি বিয়ের জন্য তৈরি পিনন হাদিতে জারদৌসি ও কারচুপির মতো আধুনিক উপাদান যোগ করতে শুরু করেছি। এতে পোশাকে যেমন ফিউশনের ছোঁয়া লেগেছে তেমনি ঐহিহ্যবাহী এই পোশাকটিন আবেদন যেন তরুণ প্রজন্মকে শেকড়ের কাছে নিয়ে যেতে পারে সেটিও নিশ্চিত হয়েছে।'
এক সেট পিনন হাদি তৈরি করতে এক মাসের মতো সময় লাগে বলে জানালেন তেনজিং চাকমা।
তিনি জানান, তার তৈরি সাধারণ পিনন হাদির সেট বিক্রি হয় ৪ হাজার থেকে ৮ হাজার হাজার টাকায়। এই পোশাকটিই যদি বিয়ের কনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয় তখন এর দাম পড়ে যায় ৬৫ হাজার টাকা বা তারও বেশি। কাপড়ের মান, বুনন, কাজসহ অন্যান্য সূক্ষ্ম বিষয়ের ওপর মূলত দাম ওঠানামা করে।
রাঙ্গামাটিতে প্রতি রবি ও বুধবারের বাজারে সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয়। এসব বাজারে গেলে আপনি বেশ সুলভ দামেই কোমর তাঁতে বোনা ঐতিহ্যবাহী পিনন হাদি কিনতে পারবেন, জানালেন বিখ্যাত এই ডিজাইনার।
অনলাইনে সহজলভ্যতার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বিপণন কৌশলের মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পিনন হাদি একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির নিদর্শন থেকে ফ্যাশন স্টেটমেন্টে পরিণত হয়েছে। ঐহিত্য আর আধুনিকতার মিশেলে পরিণত হয়েছে এক নান্দনিক পোশাকে।
এটি আদিবাসী কারুশিল্পের প্রতি আবেদন এবং সমসাময়িক ফ্যাশনে ঐতিহ্যের মেলবন্ধনেরও প্রমাণ।
মডেল: উপামা চাকমা, কোচপানা চাকমা, ত্রিজিতা খীসা, শিসটী খীসা, আনুশকা চাকমা, সুমেধা চাকমা
পোশাক: সজপদর বাই তেনজিং চাকমা
মেকআপ আর্টিস্ট: মোহাম্মদ আবু সালেম
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments