বিয়ের ডামাডোলে দেশীয় আমেজে হোক ছিমছাম হলুদ সন্ধ্যা
বেহিসাবি খরুচে বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিড়ে এখন অনেক দম্পতিই ফিরতে চাইছেন বাঙালি ঐতিহ্যের শেকড়ে। তাই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য বেছে নিচ্ছেন হলুদ শাড়ি, তাজা ফুলের গয়না আর সহজ কিন্তু অর্থপূর্ণ রীতিনীতি। তাই নিজের হলুদ আয়োজনকে স্মরণীয় করে রাখতে আপনিও বেছে নিতে পারেন খাঁটি বাংলাদেশি অনুষ্ঠান।
শেষ বিকেলের সূর্য যখন অস্ত যায়, নীল আকাশের একটা অংশ তখন লালচে আভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেইসব সন্ধ্যার জন্য আছে বিশেষ সুর। এমনই সন্ধ্যায় এক সময় পরিবারের কাছের মানুষ আর বন্ধুদের নিয়ে আয়োজন করা হতো হলুদ সন্ধ্যার। পরিবারের কারো বিয়ে উপলক্ষে জড়ো হওয়া আত্মীয়-স্বজন বর-কনের গালে আর শরীরে মাখিয়ে দিতেন কাঁচা হলুদ বাটা। খালা-ফুপু শ্রেণির মানুষ ধরতেন লোকগীতি, সেই গানের সঙ্গে নাচতেন চাচাত-খালাত-মামাত ভাইবোনেরা। সবমিলিয়ে বিয়ে বাড়িতে সৃষ্টি হতো দারুণ এক আনন্দের পরিবেশ।
দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, পেছনের এসব হাসিমাখা দিন আমরা ফেলে এসেছি। এখন বিয়ের অনুষ্ঠান এত বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হয় যে, তার কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ধার করা সংস্কৃতির প্রভাবে আমরা ধীরে ধীরে ভুলতে শুরু করেছি নিজেদের ঐতিহ্যগুলো, আচার-অনুষ্ঠানগুলো।
তবে এখনও কিছু মানুষ আছেন যাদের জমকালো 'সংগীত নাইট' পছন্দ নয়। পেশাদার কোরিওগ্রাফারের কাছে শেখা হিন্দি আইটেম গানের সঙ্গে নাচতেও তারা স্বচ্ছন্দ্য নন। অনেক দম্পতিই এখন ধার করা সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ছিমছাম দেশী ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনছেন। পুরোনো দিনের সব রীতি-নীতি মেনে তারা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করছেন।
কারণ আমাদের বাঙালি ঐহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং এর যে আচার-অনুষ্ঠানগুলো, সেগুলো অনেক অর্থপূর্ণ।
গায়ে হলুদের আয়োজনটি হয় দারুণ রঙিন আর আনন্দের। বেশিরভাগ সময়ই হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য হলুদ রঙের শাড়ি বেছে নেন কনেরা। এই রংটি বাংলাদেশের কনেদের স্বাভাবিক যে গায়ের রং, তার সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে যায়। তাছাড়া হলুদের রয়েছে নানা ধরনের শেড। যেমন কোনোটি সূর্যমুখীর পাপড়ির রং, কোনোটি ভুট্টার রং, আবার কোনোটি আনারসের মতো হালকা শেডের হলুদ।
যে কনেরা কিছুটা ভিন্ন হলুদ পরতে চান, তাদের জন্যও রয়েছে নানা শেড। হলুদের সবচেয়ে ভালো দিক হলো এটাই। সবার পছন্দের, সবার গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কোনো না কোনো শেড ঠিকই পাওয়া যায়।
গায়ে হলুদের বৈশিষ্ট্য হলো এই দিনে নানাভাবে স্টাইলিং করা যায়। এখন পর্যন্ত গায়ে হলুদের জন্য শাড়িই সবচেয়ে পছন্দের পোশাক। বাংলাদেশি কনেরাও তাই শাড়িই বেশি বেছে নেন। আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটে শাড়িতে। শাড়ি আপনাকে কখনোই হতাশ করবে না। আপনি চাইলে ঐতিহ্যবাহী বুননের শাড়ি যেমন কাতান, জামদানি বা মসলিন বেছে নিতে পারেন।
এখন তো পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি কাস্টমাইজও করা যায়। অধিকাংশ ডিজাইনাররাই কনের পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি নকশা করতে পছন্দ করেন।
যদি হলুদ শাড়ির সঙ্গে কন্ট্রাস্ট রঙের ব্লাউজ পরতে চান তাহলে বেগুনি রং বেছে নিতে পারেন। আবার লাল-হলুদ শাড়িও ভীষণভাবেই ঐতিহ্যবাহী। বহু আগে থেকেই বাঙালি কনেরা চওড়া লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি পরে গায়ে হলুদের আয়োজনে বসেন।
হলুদের শাড়িতে জারদৌসি এবং কারচুপির কাজও চমৎকার মানিয়ে যায়। হলুদ শাড়িতে গোলাপি, লাল বা সবুজের বিভিন্ন শেড দিয়ে তৈরি প্যাচওয়ার্কের আঁচলও দারুণ মানিয়ে যেতে পারে। হলুদের শাড়ির সঙ্গে ম্যাগি হাতার ব্লাউজ বেশ ভালো লাগে দেখতে। ব্লাউজের কাপড়ের ক্ষেত্রে বেছে নিতে পারেন ভেলভেট, যা বেশ রাজকীয় ভাব এনে দিতে পারে।
গায়ে হলুদে বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবেই কাঁচা ফুলের গয়না পরা হয়। কাঁচা ফুলের গয়না কনের সাজে দারুণ প্রাণবন্ত ভাব এনে দেয়, যার সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। তবে এটা পুরোপুরি ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। কাঁচা ফুলের গয়নার বিকল্প হতে পারে শুকনো ফুলের গয়নাও। এই গয়না দীর্ঘদিন সংরক্ষণও করা যায়। যে কনেরা হলুদের গয়নায় কিছুটা রাজকীয় ভাব আনতে চান তারা ফুলের সঙ্গে কুন্দনের গয়নাও যুক্ত করতে পারেন।
সাধারণত কুঁচি স্টাইলেই শাড়ি পরা হয়, তবে গায়ে হলুদে এক প্যাঁচে শাড়ি পরার চলও আছে বেশ। এভাবে শাড়ি পরলে বাঙালিয়ানাও ফুটিয়ে তোলা যায়। চুলে খুব বেশি কিছু না করে সাধারণ ছিমছাম বেণি করে তাতে রজনীগন্ধার মালা জড়িয়ে নিলে চমৎকার দেখায়। চাইলে বেণি-খোঁপা করে তাতে জড়িয়ে নেওয়া যায় বেলী ফুলের গাজরাও।
মেকআপের ক্ষেত্রে বেছে নিতে পারেন ন্যাচারাল টোনের ডিউয়ি সাজ, সঙ্গে যদি একটি লাল টিপ যুক্ত করেন তাহলে তা হবে একেবারে সোনায় সোহাগা।
তো হবু কনেরা, আর দেরি কেন? নিজের গায়ে হলুদে কীভাবে সাজবেন, কীভাবে নিজের বাংলাদেশি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলবেন পোশাক থেকে শুরু করে রীতিরীতি পালনে; তা এখন থেকেই ঠিক করতে শুরু করে দিন।
মডেল: সুহি
স্টাইলিং: সোনিয়া ইয়াসমিন ইশা
পোশাক: টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির
গহনা: শৈলী বাই তাহমিনা শৈলি
মেকআপ: সুমন রাহাত অ্যান্ড টিম
সেট: এসকে ডেকোর বাই সাইমুল করিম
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments