যে কারণে গাজায় যুদ্ধ বন্ধে বারবার ব্যর্থ জাতিসংঘ

প্রায় দুই বছর আগে গাজায় নতুন করে সংঘাত শুরুর পর থেকেই বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টায় এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ। কিন্তু ১৯৩ দেশের এই সংস্থার সব প্রচেষ্টাই এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। তা সত্ত্বেও হাল ছাড়েননি মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও তার সংস্থা।
আজ বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়—সাধারণ পরিষদে গাজায় অবিলম্বে, বিনা শর্তে ও স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির খসড়া প্রস্তাবের ওপর ভোট হবে। এর আগে গত সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিষদেও একই ধরনের প্রস্তাব এসেছিল। তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোয় বাতিল হয়ে যায়।
সাধারণ পরিষদের আগের উদ্যোগ
এর আগেও সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেছে। তবে সব প্রচেষ্টা উপেক্ষিত থেকেছে। সাধারণ পরিষদে নিরাপত্তা পরিষদের মতো ভেটো প্রক্রিয়া যেমন নেই, তেমন নেই এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা।
২০২৩ সালের অক্টোবরে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অবিলম্বে গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতি চালুর প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১২০ দেশ।
একই বছরের ডিসেম্বরে একই ধরনের আরেক প্রস্তাবে সায় দেয় ১৫৩ দেশ।
এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অবিলম্বে, বিনা শর্তে ও স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ১৫৮ ভোট পড়ে।
প্রস্তাব পাস হলেও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা নেই
কূটনীতিকরা বলছেন, এবারের প্রস্তাবটি ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদে বড় আকারে সমর্থন পেয়ে পাস হতে যাচ্ছে।

সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন কূটনীতিকরা। এই ভোটের সিদ্ধান্তে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের বিষয়ে বৈশ্বিক জনমতের প্রতিফলন পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তারা।
ইসরায়েলি বিরোধিতা
তবে যথারীতি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে ইসরায়েল। সপ্তাহজুড়ে দেশটি এই প্রস্তাবের বিপরীতে অন্যান্য দেশের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কূটনীতিক তৎপরতা দেখিয়েছে। ইসরায়েলের ভাষায়, এই প্রস্তাব 'রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ও প্রহসনমূলক, এবং এতে কাজের চেয়ে অকাজ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।'
আজকের প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি হামাসের হাতে জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি ও গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা শতভাগ প্রত্যাহারের বিষয়গুলোও আছে।
প্রস্তাবে অবাধ ত্রাণের প্রবাহ নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে এবং 'বেসামরিক মানুষকে অনাহারে রাখাকে যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার, অবৈধভাবে মানবিক ত্রাণের প্রবাহ বন্ধ করা ও বেসামরিক মানুষকে জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক উপকরণ থেকে বঞ্চিত করার প্রতি তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।'
তবে তা অস্বীকার করেছে ইসরায়েল।
জাতিসংঘে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন সদস্য রাষ্ট্রদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলেন, 'এটা একই সঙ্গে মিথ্যা ও অবমাননাকর।'

ড্যানন জাতিসংঘের খসড়া প্রস্তাবকে 'অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও ক্ষতিকারক' বলে অভিহিত করেন এবং সদস্য দেশগুলোকে এই 'প্রহসনমূলক' উদ্যোগে অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানান। তার ভাষায়, এই প্রস্তাব জিম্মি-বন্দি মুক্তির দরকষাকষিকে অবমাননা করছে এবং এটি হামাসকে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদের আগের উদ্যোগ
অপরদিকে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অন্তত নয়বার গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত প্রস্তাব আনা হয়।
পাঁচবার ভেটো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাঁচটি প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবর ও ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ও ২০ নভেম্বর এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৪ জুন ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিষদে মানবিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ওঠে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দিলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক (নয়টি) ভোটের অভাবে প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। রাশিয়ার ওই প্রস্তাবের পক্ষে পাঁচ ও বিপক্ষে চারটি ভোট পড়ে। ভোটদানে বিরত থাকে ছয় দেশ।
এরপর ১৮ অক্টোবর ব্রাজিলের আনা প্রস্তাবে ১২ দেশ সায় দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়।
১৫ নভেম্বরের প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির বদলে 'সাময়িক বিরতির' কথা বলা হয়। এই প্রস্তাবে ভেটো পড়েনি। তবে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নও হয়নি। এতে ১২ দেশ ভোট দেয় ও তিন দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।

৮ ডিসেম্বর আরব আমিরাতের আনা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আলজেরিয়ার প্রস্তাবেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই ভোটে ১৩ দেশ যুদ্ধবিরতির পক্ষে রায় দেয়। যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত থাকে।
একই বছরের ২৪ মার্চ রমজান মাসে 'সাময়িক যুদ্ধবিরতির' প্রস্তাবের পক্ষে ১৪ দেশ ভোট দেয়। ভোট দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে ওই যুদ্ধবিরতিও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হয়নি।
একই বছরের ১০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের 'তিন ধাপে' যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ১৪ দেশ সায় দেয়। রাশিয়া ভোট দেয়নি সেবার। ওই প্রস্তাবে কাতারের মধ্যস্থতায় হামাস-ইসরায়েলের মধ্যে দরকষাকষির পক্ষে মত দেওয়া হয়। তবে দুই পক্ষ এক মত না হওয়ায় সেই উদ্যোগও আলোর মুখ দেখেনি।
২০২৪ সালের ২০ নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের ১০ নির্বাচিত সদস্য রাষ্ট্রের আনা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ১৪ দেশ রাজি থাকলেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
সর্বশেষ এ বছরের ৪ জুন আবারও 'ই-১০' নামে পরিচিত ওই ১০ দেশের আনা প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো-খড়গে বলি হয়।
সব মিলিয়ে এটাই স্পষ্ট, ধারাবাহিকভাবে 'ইসরায়েলের স্বার্থ' রক্ষা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ভেটো দিয়ে বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় বানচাল করেই যাচ্ছে দেশটি।
ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত গাজা
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালিয়ে এক হাজার ২০০ ব্যক্তিকে হত্যা করে হামাস। তাদের হাতে জিম্মি হয় প্রায় ২৫০ জন। সেদিনই গাজায় প্রতিশোধমূলক ও নির্বিচার সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল।
মাঝে দুই দফায় অল্প দিনের যুদ্ধবিরতি বাদে পুরো সময়টা ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত আছে।

এসব হামলায় ৫৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
ইসরায়েলের আকাশ, নৌ ও স্থলপথে পরিচালিত হামলায় গাজার বেশিরভাগ অংশই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আল-আওদা হাসপাতালের সুত্ররা জানিয়েছেন, আজ সকালে ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর আবারও গুলি চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনা। এতে অন্তত ১৩ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হয়েছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গতকাল বুধবার ত্রাণ নিতে এসে অন্তত ৫৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
Comments