ট্রাম্প-মাস্ক বিবাদ: যেভাবে শুরু, যেভাবে চলছে

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ও সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাজনীতিকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব—একটি বাজেট বিলকে কেন্দ্র করে স্পেসএক্স প্রধান ইলন মাস্ক ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্কে এতই বড় ফাটল ধরেছে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে।
ট্রাম্পের কর ও ব্যয়-সংক্রান্ত বাজেট বিলকে তুলোধুনো করে মাস্ক বলেছেন, এজন্য ট্রাম্পের অভিশংসন হওয়া উচিত। জবাবে মাস্কের কোম্পানিগুলোকে দেওয়া সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তি বাতিল করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এই বিবাদ-কেন্দ্রিক ট্রল ও মিমে ছেয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। টেসলার শেয়ারমূল্য রাতারাতি নেমে গেছে, অপরদিকে ব্যবহারকারীদের অতিরিক্ত চাপে ঠিকমতো কাজ করছে না ট্রাম্পের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল।
যেভাবে শুরু
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন মাস্ক, রিপাবলিকান নেতার নির্বাচন জয়ে যা বড় ভূমিকা রেখেছে।
হোয়াইট হাউজে ফেরত যাওয়ার পর এই দুজনের সখ্যতা এতই বেশি ছিল যে মাস্ককে কিছু মার্কিন গণমাধ্যম (ফার্স্ট লেডির আদলে) 'ফার্স্ট বাডি' খেতাব দিয়েছিল। ট্রাম্পের ওপর মাস্কের অতিরিক্ত প্রভাবের সমালোচনা করে অনেক ডেমোক্র্যাটিক নেতা তাকে 'প্রেসিডেন্ট ইলন' বলেও ডাকা শুরু করেছিল।
ট্রাম্পের ক্যাবিনেটে সরকারি দক্ষতা বিভাগের (ডিওজিই) দায়িত্ব নেওয়া মাস্কের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের মনোমালিন্যের গুঞ্জন শোনা যেতে শুরু করে এপ্রিল মাসে। তখন মাস্ক ঘোষণা দেন, তিনি ডিওজিইতে কম সময় ব্যয় করবেন। পরোক্ষভাবে ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধেরও সমালোচনা করেন তিনি। ট্রাম্প শুল্কযুদ্ধ শুরু করার পর টেসলা ও ইলনের অন্যান্য কোম্পানির শেয়ারমূল্য কমে যাওয়াকে এর পেছনে একটি কারণ হিসেবে দেখা হয়।
মে মাসের শেষদিকে ডিওজিই থেকে পদত্যাগ করেন মাস্ক। এরপরই প্রকাশ্যে ট্রাম্পের কর ও ব্যয় বিলের সমালোচনা করতে শুরু করেন তিনি, এই বিলকে একটি 'জঘন্য জিনিস' বলে আখ্যা দেন।
এ বাজেট বিলে কোটি কোটি ডলারের করছাড়, প্রতিরক্ষা খাতে খরচ আরও বাড়ানো ও সরকারকে বেশি ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। হাজার পৃষ্ঠার অধিক এই বিল গত মাসে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হয়।
যে যা বললেন
গতকাল বৃহস্পতিবার ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মাস্ক প্রসঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প।
'ইলনের ব্যাপারে আমি খুবই হতাশ। এই বিলের ভেতরে কী আছে, তা বেশ ভালোভাবেই জানত সে। তখন তার কোনো আপত্তি ছিল না। হঠাৎ করেই এ নিয়ে সমস্যা দেখা দিল তার,' বলেন তিনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, 'আমার মনে হয় সে জায়গাটা (হোয়াইট হাউস) মিস করে। এটা আসলে ট্রাম্প ডিরেঞ্জমেন্ট সিনড্রোম। অনেকের ক্ষেত্রেই এটা হয়েছে। তারা প্রশাসন ছেড়ে চলে যায়, তারপর এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে সব জৌলুস মুছে গেছে। গোটা দুনিয়া বদলে গেছে। তখন তারা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে পড়ে।'
এই বক্তব্য চলাকালেই ট্রাম্পকে হেয় করে ও তার বিলের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক পোস্ট করেন করেন মাস্ক। পরে ট্রাম্পও যোগ দেন যোগাযোগমাধ্যমে।
ট্রুথ সোশ্যালে মাস্ককে আক্রমণ করে লেখেন, 'ইলন ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। আমিই তাকে বের করে দিয়েছি। মানুষকে জোর করে ইভি (বৈদ্যুতিক গাড়ি) কিনতে বাধ্য করা ইভি ম্যান্ডেটটা বাতিল করেছিলাম আমি, যেটা সে ভালোভাবেই জানত আমি করব, যে কারণে সে পুরো পাগল হয়ে যায়!'
এর জবাবে মাস্ক লিখেন, 'আমি না থাকলে ট্রাম্প (নির্বাচনে) হারতেন। ডেমোক্র্যাটরা হাউস (অব রিপ্রেজেন্টেটিভ) দখলে নিত, আর সিনেটে রিপাবলিকানরা কেবল ৫১-৪৯ ব্যবধানে এগিয়ে থাকত। এমন অকৃতজ্ঞতা!'
ট্রাম্প আবার মাস্ককে আঘাত করেন এই বলে, 'আমাদের বাজেট থেকে অর্থ সাশ্রয়ের, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাঁচানো সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ইলনকে দেওয়া সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তিগুলো বাতিল করা। বাইডেন কেন এটা করেননি, এটা ভেবে আমি সবসময় অবাক হতাম!'
মাস্ক পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় লেখেন, 'প্রেসিডেন্টের চুক্তি বাতিল সংক্রান্ত মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলতে চাই, স্পেসএক্স অবিলম্বে তার ড্রাগন মহাকাশযানের কার্যক্রম বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করবে।'
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশচারীদের আনা-নেওয়ার কাজে স্পেসএক্সের ড্রাগন মহাকাশযান ব্যবহার করে থাকে নাসা।
বাগবিতণ্ডার এই পর্যায়ে সবচেয়ে 'বড় বোমা'টি নিক্ষেপ করেন মাস্ক। তিনি দাবি করেন, যৌন অপরাধ ও পাচারের দায়ে অভিযুক্ত কুখ্যাত জেফ্রি এপস্টেইনের মামলার নথিতে ট্রাম্পের নাম আছে।
মাস্ক লিখেন, 'এখন একটি বড় বোমা ফেলব। এপস্টেইনের নথিতে ট্রাম্পের নাম আছে। এ কারণেই নথিগুলো এখনো প্রকাশিত হয়নি।'
ধারণা করা হয়, এপস্টেইনের নথিতে যৌন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির নাম আছে। নির্বাচনের আগে এই নথি প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প।
এরপর কী?
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ট্রাম্প-মাস্কের বিরোধ চলমান আছে। সহজে এই বিরোধ নিরসন হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন না বিশ্লেষকরা।
ট্রাম্পের সাবেক প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন ইতোমধ্যে মাস্ককে ঘায়েল করার জন্য বেশ কিছু তরিকা প্রস্তাব করেছেন। মাস্কের কোম্পানিগুলো জোরপূর্বক দখল করে নেওয়া থেকে শুরু করে মাস্কের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশছাড়া করার মতো চরম পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন তিনি।

এদিকে মাস্ক ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি আরেকটি নতুন রাজনৈতিক দলের সূচনা করতে পারেন। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, যেভাবে অর্থ খরচ করে ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছেন, সেভাবেই তার পতনও ডেকে আনার ক্ষমতা আছে মাস্কের। এছাড়া, তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-কে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প-বিরোধী ঐক্যও গড়ে তুলতে পারেন।
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, সিবিএস, আল জাজিরা।
Comments