‘গাজার জনগণ, তোমাদের সঙ্গে আছি’, যেভাবে ফিলিস্তিনিদের পাশে ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস

ভ্যাটিকানে জনতার উদ্দেশ্যে সর্বশেষ বার্তাতেও গাজার 'গুরুতর' মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আহ্বান জানিয়েছিলেন যুদ্ধবিরতির।
গাজায় আড়াই বছর ধরে চলা গণহত্যা নিয়ে সিংহভাগ বিশ্বনেতা চুপ থেকেছেন, অনেকেই নিঃশর্তভাবে সমর্থন দিয়েছেন ইসরায়েলকে। কিন্তু ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু, সদ্য-প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস কখনো তার নৈতিক মূল্যবোধ হারাননি। শুরুতেই ইসরায়েলের কার্যক্রমকে 'সন্ত্রাসী' আখ্যা দিয়েছেন, গণহত্যার তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন, নিয়মিত খোঁজ নিয়েছেন গাজার ফিলিস্তিনিদের।
চলুন জেনে নেই খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু হিসেবে ১২ বছরের সময়কালে যেভাবে ফিলিস্তিনের পাশে থেকেছেন পোপ ফ্রান্সিস।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘসময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে ভ্যাটিকান। কিন্তু ২০১৩ সালে পোপের চেয়ারে বসার পরের বছরই ফিলিস্তিন সফর করেন পোপ ফ্রান্সিস। পশ্চিম তীরে দেখা করেন মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে। বেথেলহামে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনকে পৃথক করা—'বর্ণবাদী দেয়াল' ও 'ফ্রি প্যালেস্টাইন' লেখা একটি দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেন।
এর পরের বছর ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভ্যাটিকান। ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সঙ্গে স্থাপন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক।

গণহত্যাকালে পোপ ফ্রান্সিস
'যুদ্ধ না, সন্ত্রাস'
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় গণহত্যা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। শুরু থেকেই বেসামরিক জনগণ ও অবকাঠামোগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হলেও ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলো এই গণহত্যাকে 'হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' বলে আখ্যায়িত করেছে।
নভেম্বরে এক বক্তৃতায় পোপ ফ্রান্সিস বলেন, 'এটা কোনো যুদ্ধ না, এটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।'
চলতি মাসেই 'হোপ নেভার ডিজাপয়েন্টস: পিলগ্রিমস টুওয়ার্ডস এ বেটার ওয়ার্ল্ড' শিরোনামে পোপের লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়। বইয়ের এক জায়গায় তিনি গাজা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি লিখেন, 'কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, গাজায় যা ঘটছে তাতে গণহত্যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।'
গণহত্যা শুরু হওয়ার পরদিন থেকে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে দেওয়া অনেক বক্তৃতায় গাজার প্রসঙ্গ এনেছেন পোপ ফ্রান্সিস। প্রতিবারই তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়েছেন। ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি হামাসের হাতে বন্দী ইসরায়েলিদের জন্যও প্রার্থনা করেছেন তিনি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতির পর আবার ইসরায়েল হামলা শুরু করলে রোববারের এক প্রার্থনায় পোপ বলেন, 'যুদ্ধবিরতিটা ভেঙে যাওয়ায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। আবার মৃত্যু, ধ্বংস ও দুর্দশা শুরু হয়েছে।'
ইসরায়েলের হামলা ও ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'গাজায় এত দুর্ভোগ। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে মানুষকে।'
২০২৪ সালের এপ্রিলে গাজার ত্রাণকর্মীদের ওপর ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানান পোপ ফ্রান্সিস।
'গাজায় ত্রাণ বিতরণের সময় নিহত স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য আমার মন কাঁদছে। তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য আমার প্রার্থনা,' ভ্যাটিকানে এক বক্তৃতায় বলেন তিনি।
ইসরায়েল 'যুদ্ধ উসকে দেওয়া' শক্তি
২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় গণহত্যা শুরুর প্রথম বর্ষপূর্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখেন পোপ। সেখানে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে অনুরোধ করেন খ্রিস্টানদের। বাইবেলের একটি বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের প্রার্থনা ও উপবাস করতে বলেন।
'প্রার্থনা ও উপবাস হলো প্রেমের অস্ত্র, যা ইতিহাস বদলে দেয়। এই অস্ত্রই আমাদের একমাত্র সত্যিকারের শত্রু—যুদ্ধ উসকে দেওয়া সেই দুষ্ট আত্মাকে পরাজিত করবে। কারণ সে "শুরু থেকেই হত্যাকারী", "মিথ্যাবাদী এবং মিথ্যার বাবা''' (জন ৮:৪৪)।
এখানে 'যুদ্ধ উসকে দেওয়া' শক্তি বলতে পোপ ইসরায়েলকেই বুঝিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।
চিঠিতে গাজাবাসীর উদ্দেশ্যে পোপ লিখেন, 'গাজার জনগণ, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধে জর্জরিত, দুঃসহ পরিস্থিতিতে আটকে থাকা জনগণ—তোমাদের কথা আমি প্রতিদিন ভাবি, তোমাদের জন্য প্রতিদিন প্রার্থনা করি।'
দখলদার ইসরায়েলের সমালোচনা
নভেম্বরে ভ্যাটিকানে কূটনীতিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে ইসরায়েলকে সরাসরি 'দখলদার' বলে আখ্যা দেন।
তিনি বলেন, 'মানবতার দুটি ব্যর্থতার কথা বলব। ইউক্রেন ও ফিলিস্তিন। দুই জায়গাতেই মানুষ ভোগান্তির মধ্যে আছে। সেখানে দখলদারদের ঔদ্ধত্যের নিচে চাপা পড়ছে সংলাপ।'
সবসময় শান্তির কথা বলা পশ্চিমা বিশ্বের কপটতাকে খোঁচা দিয়ে তিনি বলেন, 'শান্তির কথা বলে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মেতে ওঠার যে ভণ্ডামি, সেটিই আমাদের বারবার ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যায়।'
ফিলিস্তিনি কেফিয়ায় মোড়ানো যীশু
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বড়দিনের প্রাক্কালে ভ্যাটিকানে এক অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনিদের ঐতিহ্যবাহী স্কার্ফ কেফিয়াতে শিশু যীশুর মূর্তি রাখা হয়। সেই অনুষ্ঠানে একাধিক ফিলিস্তিনি শিল্পী ও কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।
বড়দিনের অনুষ্ঠানে শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করে ইসরায়েলের চালানো বিমান হামলার নিন্দা জানান পোপ। তিনি বলেন 'গতকাল দেখলাম, শিশুদের ওপর বোমা মারা হচ্ছে। এটাকে যুদ্ধ বলা যায় না। এটা শ্রেফ নির্মমতা।'

২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গাজার প্রায় সব হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ ও জ্বালানি অবকাঠামো ধ্বংস করে ফেলেছে ইসরায়েল। ওই মাসে এক বিবৃতিতে ফ্রান্সিস বলেন, 'আমরা কোনোভাবেই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা হামলা মেনে নিতে পারি না।
শীতে ঠাণ্ডায় মারা যাওয়া শিশুদের স্মরণে তিনি বলেন, 'হাসপাতাল ধ্বংস, জ্বালানি অবকাঠামো ভেঙে দেওয়ার কারণে একটি দেশে শিশুরা ঠাণ্ডায় মারা যাচ্ছে। এটি আমরা মেনে নিতে পারি না।'
সীমা ছাড়িয়ে গেছে ইসরায়েল
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে গাজার পাশাপাশি লেবাননেও হামলা শুরু করে ইসরায়েল। লেবাননে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হওয়ার পর এক সাংবাদিক এ ব্যাপারে পোপের মন্তব্য জানতে চান।
প্রতিটি হামলার পর 'আত্মরক্ষার্থে আক্রমণ করেছি' এমন যুক্তি দেখানো ইসরায়েলের নাম উল্লেখ না করে সমালোচনা করেন পোপ ফ্রান্সিস।
তিনি বলেন, 'আক্রমণের সঙ্গে আত্মরক্ষার একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে।'
'যখন অতিরিক্ত বা অসমভাবে কিছু করা হয়, তখন সেখানে এমন আধিপত্যের প্রবণতা দেখা যায়, যা নৈতিকতাকে ছাড়িয়ে যায়, সীমাকে ছাড়িয়ে যায়,' যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ একটা অনৈতিক কাজ হলেও সেখানেও কিছু 'নৈতিকতার আইন' আছে।
'যখন কোনো দেশ তা মেনে না চলে, তখনই আমরা এমন ভয়াবহ রক্তপাত দেখতে পাই,' বলেন ফ্রান্সিস।
এই উদ্ধৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল যে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে, সেই ইঙ্গিতও দেন তিনি।
পোপের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অবস্থান
ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ নিয়ে পোপের প্রায় প্রতিটি বক্তব্যের পরই সমালোচনা জানিয়েছে ইসরায়েলি শিবির।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলের গণহত্যা নিয়ে মন্তব্যের পর দেশটির প্রবাসীবিষয়ক মন্ত্রী আমিচাই চিকলি এক চিঠিতে দাবি করেন, এই মন্তব্যের মাধ্যমে 'হলোকাস্ট অস্বীকারের কাছাকাছি' চলে এসেছেন পোপ।
ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর বোমাবর্ষণের সমালোচনা করার জন্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পোপের বিরুদ্ধে 'ডাবল স্ট্যান্ডার্ড' বা 'দ্বিমুখী আচরণ'র অভিযোগ আনে।
২০২৪ সালের বড়দিনে ফিলিস্তিনি কেফিয়ায় যীশুর মূর্তি মোড়ানোর পর পোপ ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে 'রক্তকলঙ্কের' অভিযোগ আনে ইসরায়েল।
'একজন বন্ধু হারাল ফিলিস্তিন'
নিজের শেষ বক্তৃতায়ও গাজায় যুদ্ধবিরতির ডাক দেওয়া পোপ ফ্রান্সিসকে সবসময় বন্ধু হিসেবেই দেখেছে গাজাবাসী। এনপিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় গণহত্যা শুরু হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন গাজার রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, গাজাবাসীর খবর নিতেন। তার পরামর্শে যুদ্ধ চলাকালে গাজার ক্যাথলিক চার্চগুলো অনেক মুসলিম ফিলিস্তিনিকে আশ্রয় দিয়েছে।
পোপের মৃত্যুর পর বেথলেহেমের ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ মুনথার আইজ্যাক এক শোকবার্তায় লিখেন, 'ফিলিস্তিনিরা আজ এক প্রিয় বন্ধুকে হারাল।'
'ফিলিস্তিনিদের প্রতি, বিশেষ করে এই গণহত্যার সময় গাজাবাসীর প্রতি তিনি যে সহানুভূতি দেখিয়েছেন, তার তুলনা হয় না,' যোগ করেন তিনি।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) কমিশনার-জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেন, 'গাজার চরম মানবিক বিপর্যয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে তার কণ্ঠস্বর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।'
'ফিলিস্তিনি শরণার্থী ও ইউএনআরডব্লিউএর তার সমর্থনের জন্য আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ,' যোগ করেন তিনি।
সূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, জেরুজালেম টাইমস, টাইমস অব ইসরায়েল, এনপিআর, সিবিএস ও আরব নিউজ।
Comments