ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্যোগে যত আইনি জটিলতা

হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বাধীন বেশ কিছু অঙ্গরাজ্য ও শহর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক একটি নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করেছে। ক্ষমতা গ্রহণ করেই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার বাতিলের যে উদ্যোগ নেন, সেটারই বিরোধিতা করছে ১৮টি অঙ্গরাজ্য ও ছয়টি শহর।

এই আদেশ আসার আগেই বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছিলেন, এর বাস্তবায়নে দেখা দেবে আইনি জটিলতা। মূল কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার নজির নেই। 

মামলায় যে অভিযোগ আনা হচ্ছে

এসব মামলার মূল অভিযোগ, ট্রাম্পের সোমবারের নির্বাহী আদেশ মার্কিন সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীকে ক্ষুণ্ণ করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম নেওয়া সব শিশু দেশটির নাগরিকত্বের অধিকার পায়।  

১৮টি অঙ্গরাজ্য, ওয়াশিংটন ডিসি ও সান ফ্রানসিসকোর দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, 'বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্টের অভিবাসন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেওয়ার নির্দেশ প্রেসিডেন্টের আইনি এখতিয়ার বহির্ভূত।' 

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ঘাঁটিতে মামলা দায়ের

এটাই হতে পারে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে প্রথম, বড় আকারের আইনি লড়াই।

১৮টি অঙ্গরাজ্য ম্যাসাচুসেটস ফেডারেল কোর্টে এই মামলা দায়ের করেছে। যার অর্থ হল, এই আদালতের কোনো রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে তা ফার্স্ট ইউএস কোর্ট অব আপিলস এর মাধ্যমে যেতে হবে।

ঘটনাচক্রে ওই আপিল আদালতের সব বিচারকই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নিয়োগ দেওয়া, যা ট্রাম্পের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

এর আগেও মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্যোগ নাকচ হয়েছে। কংগ্রেসে একটি ফেডারেল আইন পাস করা হয়েছে, যা ১৫০ বছরের পুরনো এই সাংবিধানিক অধিকারকে আরও শক্তিশালী করেছে।

নিউজার্সির অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যাথু প্ল্যাটকিন । ছবি: সংগৃহীত
নিউজার্সির অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যাথু প্ল্যাটকিন । ছবি: সংগৃহীত

নিউ জার্সির ডেমোক্র্যাটিক অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যাথু প্ল্যাটকিন সিএনএনকে জানান, 'প্রেসিডেন্ট তার প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেন। কিন্তু যখন বিষয়টি নাগরিকত্ব নিয়ে—যেটি এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই দেশের অংশ, যেটা সিভিল ওয়ারের পর থেকে ১৫৭ বছর ধরে মার্কিন ইতিহাস ও সংবিধানের অংশ, যেই অধিকার সুপ্রিম কোর্ট দুইবার অক্ষুণ্ণ রেখেছে—চাইলেই প্রেসিডেন্ট কলমের খোঁচায় সেই আইন-অধিকারকে বাতিল করতে পারেন না। পারেন না সংবিধানকে নতুন করে লিখতে।'

এই মামলার বাদী পক্ষে নেতৃস্থানীয় আইনজীবীর ভূমিকায় থাকছেন প্ল্যাটকিন। 

অন্যান্য আদালতেও মামলা

মঙ্গলবার ওয়াশিংটন, অ্যারিজোনা, ওরেগন ও ইলিনয়ের অ্যাটর্নি জেনারেলরাও ওয়েস্ট কোস্টে পৃথক ভাবে এই নীতিমালার বিরোধিতা করে মামলা দায়ের করেছেন। সিয়াটলের ফেডারেল আদালতে এই মামলা দায়ের করা হয়। এখানেও মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সেটি নবম মার্কিন সার্কিট আদালতের মাধ্যমে যাবে, যেটি প্রথাগতভাবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল।

উভয় মামলাতেই (অঙ্গরাজ্য ও শহরের) প্রাথমিক আদেশের মাধ্যমে এই নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ স্থগিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

অর্থাৎ, আইনি লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই নীতি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নেই বুলেই চলে।

পাশাপাশি, নতুন এই নির্বাহী আদেশ ঠেকাতে সোমবার আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন (এসিএলইউ) ও আবাসন অধিকার সংগঠনগুলোও মামলা ঠুকেছে।

আইনি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ট্রাম্প প্রশাসন

নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। ছবি: এএফপি
নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। ছবি: এএফপি

প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই নির্বাহী আদেশে সই দেন ট্রাম্প। তবে তার সহযোগীরা আগে থেকেই জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী আইনি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন বলে জানা গেছে। 'নজিরবিহীন' এই আদেশে যে তাৎক্ষণিকভাবে লক্ষ্য পূরণ হবে না, সেটা জেনে-বুঝেই তারা প্রস্তুতি নিয়েছেন।

দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশটি তারা বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে সহযোগীরা আত্মবিশ্বাসী।

নির্বাহী আদেশে যা বলা হয়েছে

নির্বাহী আদেশে সাক্ষর করছেন ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
নির্বাহী আদেশে সাক্ষর করছেন ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নির্বাহী আদেশের 'ফ্যাক্ট শিটে' বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে দেশটির যেকোনো কেন্দ্রীয় সংস্থা কাউকে মার্কিন নাগরিকত্বের সনদ বা স্বীকৃতি দেয় এমন কোনো নথি দিতে পারবে না। 

এ বিষয়টি নির্দেশ জারির ৩০ দিন পর থেকে জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

মূলত, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বা সাময়িকভাবে বসবাস করছেন এমন পিতা-মাতার সন্তানদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য।

পাশাপাশি, সন্তানের মা যদি ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসে থাকে (সাময়িক ভাবে) এবং পিতা যদি মার্কিন নাগরিক না হন, তাহলে সেই সন্তান নাগরিকত্ব পাবে না।

বর্তমান আইন মতে, পিতা মাতার নাগরিকত্ব যাই হোক, তাদের ভিসা থাকুক বা না থাকুক, তারা বৈধ বা অবৈধ, যেভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করুক—মার্কিন ভূখণ্ডে সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তান মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার উপভোগ করে।

জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের নির্বাহী আদেশে সই করেছেন ট্রাম্প। প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের নির্বাহী আদেশে সই করেছেন ট্রাম্প। প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু ট্রাম্পের আদেশে এ বিষয়টি বদলানোর চেষ্টা এসেছে।  

এই নির্দেশে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, জন্মসূত্রে সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া 'চতুর্দশ সংশোধনীর এখতিয়ার বহির্ভূত।'

কিছু কট্টর নেতা যুক্তি দিয়েছেন, অবৈধ বা নথিবিহীন অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে 'আইনের আওতাধীন নয়' এবং এ কারণে সংবিধানমতে তাদের (বা তাদের সন্তানদের) মার্কিন নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়।

তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুক্তি ধোপে টিকবে না, কারণ এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া বিদেশি কূটনীতিবিদদের সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পাশাপাশি, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে আগ্রাসন চালালে সে ক্ষেত্রেও এই যুক্তি সামনে আসতে পারে, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থাৎ, প্রশ্নটা এরকম, একজন বিদেশি সেনা সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে হামলা চালানোর সময় সন্তান জন্ম দিলে সেই সন্তান মার্কিন নাগরিকত্ব পাবে কী না।

প্রস্তুত ট্রাম্পের প্রতিপক্ষরাও

আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন (এসিএলইউ) ও অ্যাটর্নি জেনারেলরা জানিয়েছেন, তারা আইনি লড়াইয়ের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন। তারা মনে করেন, তাদের পক্ষেই যুক্তির পাল্লা ভারী এবং ট্রাম্পের এই আদেশ বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা নেই।

তাদের মতে, ট্রাম্প বেশ কিছু অভিবাসন সংক্রান্ত আদেশ দেবেন এবং সবগুলোর বিরুদ্ধেই তারা আইনি লড়াই চালাবেন।

এসিএলইউ'র জাতীয় আইন বিষয়ক পরিচালক সেসিলিয়া ওয়াং বলেন, 'এই উদ্যোগ যদি আদালতে বন্ধ না করা যায়, তাহলে তা মার্কিন সম্প্রদায়ের একেবারে মূলে আঘাত হানবে। ট্রাম্প জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব ও আরও অনেক অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়ে নীতি বদলানোর চেষ্টা করবেন।'

এসিএলইউ’র জাতীয় আইন বিষয়ক পরিচালক সেসিলিয়া ওয়াং। ছবি: ACLU ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত
এসিএলইউ’র জাতীয় আইন বিষয়ক পরিচালক সেসিলিয়া ওয়াং। ছবি: ACLU ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত

বেশ কয়েক বছর ধরে ট্রাম্প অভিবাসন ও জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন। যার ফলে, তার প্রতিপক্ষরা বেশ কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে।

মামলার অভিযোগ মতে, এসিএলইউর মামলার বাদীদের মধ্যে থাকছেন ট্রাম্পের বেঁধে দেওয়া ৩০ দিন সময়সীমার পরে সন্তান জন্ম দেবেন এমন পিতা-মাতা।

অঙ্গরাজ্যগুলো তাদের মামলার বিবরণীতে উল্লেখ করেছে, এই আদেশের ফলে অন্তত দেড় লাখ শিশু নাগরিকত্ব বঞ্চিত হতে যাচ্ছে।

'এই আদেশের ফলে ১৯ ফেব্রুয়ারির পর জন্ম নেওয়া শিশুরা আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, যা আর দুই দিন আগে জন্মালেই তারা পেতে পারত। কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে তারা "অবৈধ" হিসেব বিবেচিত হবে। তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে সরকার। অনেকেরই কোনো দেশ থাকবে না', বিবরণে আরও জানানো হয়।

আরও বিভিন্ন মানবিক যুক্তিও যোগ করা হয়েছে মামলার বিবরণীতে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, এই নির্দেশের বিপক্ষে পাল্লা বেশ ভারী।

নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি পরাজিত হলেও ট্রাম্পের শাসনামলে অযৌক্তিক সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বাইডেন-কমলার দল।

যথার্থ বিরোধীদলের ভূমিকায় তাদের প্রথম, বড় পদক্ষেপ হতে পারে অনেকের দৃষ্টিতেই জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের এই অমানবিক উদ্যোগে রাশ টেনে ধরা। 

Comments

The Daily Star  | English

Smaller in size, larger in intent

Finance Adviser Salehuddin Ahmed has offered both empathy and arithmetic in his budget speech, laying out a vision that puts people, not just projects, at the heart of economic policy.

10h ago