সন্তান নিলে ১৫১০ ডলার, তবুও জন্মহার বাড়ছে না দক্ষিণ কোরিয়ায়
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের কাছে এক অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন কউন জাং-হো ও চো নাম-হি দম্পতি। সম্প্রতি তারা তাদের ১৭ মাসের ছেলে জু-হার পেছনে খরচের হিসাব কষতে বসেছিলেন।
স্থানীয় রেডিওতে কাজ করা কউন সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, 'অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না কিনলে বা সরকারি সহায়তার সুযোগ নিলে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেক সুলভে শিশু লালনপালন করা যায়।'
মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকা চো গণমাধ্যমটিকে বলেন, 'আমরা যে ভবনে থাকি এখানেই শিশু যত্নকেন্দ্র আছে। এই সরকারি কেন্দ্রে বিনামূল্যে খেলনা পাওয়া যায়।'
বিশ্বের সবচেয়ে কম জন্মহারের দেশগুলোর অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়ায় গত বছর শিশু জন্মের হার ছিল শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ। তার আগের বছরে ছিল শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুসারে, একটি দেশে জনসংখ্যার ভারসাম্য রাখতে গেলে শিশু জন্মের হার সাধারণত ২ দশমিক ১ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু, দক্ষিণ কোরিয়ায় বইছে এর উল্টো স্রোত।
এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে দেশটির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার নবজাতকদের মা-বাবাকে অর্থসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তারপরেও দেশটিতে জন্মহার আশানুরূপ হচ্ছে না।
এক প্রজন্মের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া দারিদ্রের বেড়াজাল ভেঙে উন্নত দেশে উন্নীত হয়েছে। তবে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা তেমন জোরাল হয়। সমৃদ্ধ দেশের ফোরাম ওইসিডির ৩৮ সদস্যের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান সবার নিচে।
গত বছর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় একজন মাকে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য ১ হাজার ৫১০ ডলার বা ২০ লাখ ওন (দক্ষিণ কোরিয়ার মুদ্রা) নগদ দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়াও, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চিকিৎসা খরচ মেটাতে নানান সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বুসানে একাধিক সন্তানের মাকে আলাদাভাবে ৩৭৭ ডলার থেকে ৭ হাজার ৫৫২ ডলার পর্যন্ত বাড়তি সহায়তা দিচ্ছে।
দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দক্ষিণ জেওলা প্রদেশের গ্রামীণ এলাকায় প্রতি সন্তানের জন্য একজন মাকে ৭ বছরের জন্য প্রতি মাসে ৪৫৩ ডলার দেওয়া হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, নতুন মায়েদের জন্য এই নগদ অর্থ দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যায় ইতিবাচক ফল আনবে কিনা- তা স্পষ্ট নয়।
৩৯ বছর বয়সী দোভাষী চো জু-ইয়েওন গণমাধ্যমটিকে জানান, তিনি বিয়ে করেছেন প্রায় ১০ বছর আগে। কিন্তু, সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছেন না। সরকার কী পরিমাণ অর্থ দিচ্ছে তাও তার কাছে বিবেচনার বিষয় নয়।
চোর মতো দক্ষিণ কোরিয়ার অনেকে বিয়েতে নারাজ। আবার অনেকে বিয়ে করলেও সন্তান দিতে আগ্রহী নন।
সরকারি জরিপে দেখা গেছে, দেশটিতে ১৯ বছর থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ সন্তান নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
দেশটির অন্যান্য শহর বা প্রদেশের মধ্যে রাজধানী সিউলে জন্মহার সবচেয়ে কম। এখানে প্রতি ১০ জনের ৬ জন সন্তান নিতে আগ্রহী নন।
কোরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল স্টাডিজের জরিপ অনুসারে, দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্র ৪ শতাংশ তরুণী মনে করেন যে বিয়ে ও সন্তানের প্রয়োজন আছে।
গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় বিয়ের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯২ হাজার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাজের প্রচণ্ড চাপের পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া ও শিক্ষার খরচ আকাশ ছোঁয়া হওয়ায় এবং লিঙ্গবৈষম্যের কারণে দম্পতিরা সন্তান নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
চলতি বছরের প্রথমদিকে সংবাদমাধ্যম জুংয়াং ইলবোর জরিপে বলা হয়, ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ জবাবদাতা মনে করেন সন্তান লালনপালনের বিপুল খরচ দম্পতিদের সন্তান না নেওয়ার পেছনে মূল কারণ। অন্যরা মনে করেন, চাকরির অনিশ্চয়তা, বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কারণও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
ইনচেওন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সমাজকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক সং দা-ইয়েওং মনে করেন, কেবল নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়।
তিনি গণমাধ্যমটিকে বলেন, 'সরকারি অর্থে একটি শিশুর প্রথম ২ বছরের খরচ মেটানোর সঙ্গে শিশু লালনপালনের তেমন সম্পর্ক নেই। শিশুর বেড়ে উঠার সঙ্গে উচ্চহারে তার সুযোগসুবিধা বাড়ানোও সম্ভব নয়।'
প্রতিবেদন অনুসারে দক্ষিণ কোরিয়ায় বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে। আর দেশটিতে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল সম্প্রতি বলেছেন, জনসংখ্যা বাড়াতে সরকার গত ১৬ বছরে ২১১ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে এতে কোনো উপকার হয়নি। এ সংকট সমাধানে তিনি আরও 'সাহসী ও কার্যকর ব্যবস্থা' নেওয়ার আহ্বান জানান।
জাতিসংঘের হিসাবে দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লাখ ৯২ হাজার। দেশটিতে প্রতি বছর জনসংখ্যা কমছে। আগমী ১ জুলাই এই সংখ্যা কমে দাঁড়াবে ৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৪ হাজারে।
Comments