ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে কি

ইউক্রেন যুদ্ধ
জার্মানির হামবুর্গে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

প্রতিবেশী ইউক্রেনে পরাশক্তি রাশিয়ার 'বিশেষ সামরিক অভিযানের' এক বছরের মাথায় যুদ্ধ বন্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে কি? এই মুহূর্তে উভয় পক্ষই একদিকে যেমন যুদ্ধে নিজেদের 'বিজয়ী' দাবি করছে, অন্যদিকে 'শান্তি আলোচনায়' অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।

গতকাল শুক্রবার ইউক্রেন যুদ্ধের বছর পূর্তির দিনে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বরাত দিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আরটি জানায়, ব্রিটেন অস্ত্র পাঠানোর পাশাপাশি মস্কোর সঙ্গে 'আলোচনায়' বসার বিষয়ে কিয়েভকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।

ফ্রান্স ও জার্মানি আলোচনার এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ফ্রান্সের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, 'আমরা আবারও বলছি, এই যুদ্ধে রাশিয়া কখনোই জিতবে না। যদি যুদ্ধ চলতেই থাকে বা এটি আরও জোরালো হয় তাহলে ইউক্রেনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।'

এই ফরাসি কর্মকর্তার এমন কথাকে পশ্চিমের দেশগুলোর 'মনের কথা' বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

শুধু তাই নয়, গত বৃহস্পতিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ১২ দফা 'শান্তি' প্রস্তাবে বেইজিং এই চলমান সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ
ইউক্রেনের খিরকিভ অঞ্চলে রুশ হামলায় বিধ্বস্ত স্কুল ভবন। ছবি: রয়টার্স

বেইজিং চায়—যুদ্ধ বন্ধে আবারও শান্তি আলোচনা শুরু হোক এবং পশ্চিমের একতরফা নিষেধাজ্ঞার অবসান হোক। পরমাণু বোমা হামলার বিরোধিতা করে চীন 'বিবদমান সব পক্ষকেই যৌক্তিক আচরণ', নিজেদের 'সংযত রাখা', সবাইকে 'আগুন নিয়ে না খেলা' ও 'ধৈর্যের পরিচয়' দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

চীনের চাওয়া- 'সংঘাত যেন ছড়িয়ে না পড়ে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে না চলে যায়'।

চীনের এই প্রস্তাবের পর দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। যদিও এখন পর্যন্ত এই ২ নেতার সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে বেইজিং আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।

আজ শনিবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, যুদ্ধের ১ বছর পূর্তিতে দেওয়া ভাষণে জেলেনস্কি বলেছেন, 'চীনের এই প্রস্তাবে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, দেশটি শান্তি খুঁজছে'।

রাশিয়াও চীনের এই শান্তি প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্তায় বলা হয়েছে, 'আমরা চীনের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করি।'

তবে চীনের এই প্রস্তাব প্রসঙ্গে গতকাল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবিসি নিউজকে বলেছেন, 'প্রেসিডেন্ট পুতিন যেহেতু এই প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সেহেতু এখানে ভালোর কী থাকতে পারে?'

একইভাবে রাশিয়াও চীনের প্রস্তাব নিয়ে 'ধোঁয়াশাপূর্ণ' বক্তব্য দিয়েছে। গতকাল জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেছেন, 'ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে অর্জনে রাশিয়া আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।'

ধরে নেওয়া যেতে পারে, বাইডেনের এমন মন্তব্য পুতিনের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি ও রুশ প্রতিনিধির বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রাখার রাজনৈতিক কৌশল।

ইউক্রেন যুদ্ধ
সামরিক অভিযানের পরপরই কলম্বোয় রুশ দূতাবাসের সামনে ইউক্রেনীয় পর্যটকদের যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ। ছবি: রয়টার্স

বলা বাহুল্য, চলমান যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেন। রুশ হামলায় বিধ্বস্ত প্রায় পুরো দেশ। নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও পশ্চিমের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইউক্রেনে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। অনেক শহর ও গ্রাম 'মাটির সঙ্গে মিশে গেছে'।

এই যুদ্ধে ইউক্রেন ও রাশিয়ার অন্তত ১০ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন বলেও গণমাধ্যম প্রতিবেদন বলা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত রাশিয়ার অর্থনীতি। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও।

এদিকে যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে পড়ার আগেই পশ্চিমের গণমাধ্যমে 'নতুন করে যুদ্ধ শুরু' বা 'যুদ্ধ আরও জোরালো' হওয়ার সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

এতে বলা হয়, বিবদমান পক্ষগুলো নতুন করে সেনা সমাবেশ ঘটাচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যাধুনিক অস্ত্র পাঠানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, এ বছর যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে।

কিয়েভের তুমুল প্রতিরোধের মুখে রুশ বাহিনী পিছু হটে ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তে রুশ ভাষাভাষী অঞ্চলে অবস্থান নিয়েছে। সেখানে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অবস্থা 'খুবই শোচনীয়' উল্লেখ করে পশ্চিমের গণমাধ্যমে ক্রমাগত সহায়তা বাড়ানোর আর্তি জানানো হচ্ছে।

সেই সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্ররা ইউক্রেনে নতুন করে আরও সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, রাশিয়াকে আরও দুর্বল করতে নতুন করে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণাও আসছে।

গতকাল আরটি আরও জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিতে রাজি হয়েছে।

ইউক্রেনে রুশ অভিযানকে সমর্থন করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। যাতে রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে 'অপপ্রচার' ও যুদ্ধে অন্য দেশের ড্রোন ব্যবহার না করতে পারে।

প্রতিবেদন অনুসারে, রাশিয়ার রপ্তানি বাণিজ্য ও প্রযুক্তিখাতকে বাধাগ্রস্ত করতেই এই নিষেধাজ্ঞা।

এসব ঘটনার পরও যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনার বিষয়ে রুশ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও সোভিয়েত অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা পাভেল ফেলগেনহাউরের মন্তব্য আমলে নেওয়া যেতে পারে।

এই বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি আল জাজিরা বলেছে, চলতি বছরেই 'শান্তি' আসার সম্ভাবনা আছে।

পাভেল ফেলগেনহাউর গণমাধ্যমটিকে বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি এ বছরেই যুদ্ধ শেষ হবে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা বা যুদ্ধবিরতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে এই মুহূর্তে রাশিয়া স্থিতাবস্থা চায়। অর্থাৎ, যুদ্ধক্ষেত্রে যে যে অবস্থানে আছে সেটাকে লাইন অব কন্ট্রোল হিসেবে ধরতে চায়।'

অর্থনৈতিকভাবে চরম চাপে থাকা ইউরোপের জনগণও এই যুদ্ধের শেষ দেখতে চায়। জরিপে দেখা গেছে 'ভূমির বিনিময়ে হলেও শান্তি'র পক্ষে জনমত অনেক।

গত জানুয়ারিতে জরিপ সংস্থা ইউরোস্কোপিয়া জানিয়েছে, অস্ট্রিয়ায় ৬৪ শতাংশ, জার্মানির ৬০ শতাংশ, গ্রিসের ৫৪ শতাংশ এবং ইতালি ও স্পেনের ৫০ শতাংশ মানুষ 'ভূমির বিনিময়ে' রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিতে পৌঁছানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।

ইউরোপের মানুষের এই 'যুদ্ধবিরোধী' অবস্থানের প্রতিফলন যুদ্ধের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব ফেলুক- এমনটাই কাম্য।

Comments