নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দিলেই সিন্ডিকেট ভাঙবে?
যখনই সরকার কোনো পণ্য বা সেবার দাম বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তখনই বাড়তি সুবিধা পেয়েছে বাজারের সিন্ডিকেট। আলু থেকে চামড়া, এলপিজি থেকে পেঁয়াজ, সার থেকে চিনি, স্যালাইন থেকে ভোজ্যতেল—সাফল্যের গল্প খুব কমই আছে।
ফলে প্রশ্ন ওঠে, সরকার কেন গোড়া থেকে সমস্যার সমাধান না করে দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সেই পুরোনো পদ্ধতিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে?
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার পরিবর্তে সরবরাহ ব্যবস্থার সব সমস্যা দূর করতে পারে এবং বাজারে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক আছে কি না, তা নজরদারি করতে পারে।
সার্বিকভাবে বাজার যেন যথাযথভাবে পরিচালিত হয়, সেদিকে সরকারের নজর থাকা উচিত বলে মনে করেন তারা।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডিম, আলু ও পেঁয়াজের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পর এ বিষয়ে সরকারের ব্যর্থতা আবারও সামনে এসেছে।
মূল্য নির্ধারণের ১১ দিন পরও এই তিন পণ্যের কোনোটিই নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না।
এটা অবশ্য কোনো নতুন বিষয় না। প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সরকার কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়।
কিন্তু উচ্চ পরিবহন খরচ, লবণের মূল্য বৃদ্ধি ও শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
কৃষিখাতেও একই অবস্থা। এই খাতে সরকার ভর্তুকি মূল্যে সার দেয়। কিন্তু কৃষককে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশি দামে সার কিনতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনার পর গত বছর থেকে ডলারের দর নির্ধারণ করে আসছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন ও অ্যাসোসিয়েশন অব অব ব্যাংকার্স। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো সেই হার মানছে না।
২০২১ সাল থেকে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি মাসে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করছে, যা সাধারণত ১২ কেজি সিলিন্ডারে বিক্রি হয়।
কিন্তু আমদানিকারক, পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের যথাযথ নজরদারির আওতায় না আনায় সেই দাম এখনো কাগজে-কলমে থেকে গেছে।
সরকার চলতি মাসের জন্য ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করেছে ১ হাজার ২৮৪ টাকা। কিন্তু তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়।
ডেইলি স্টার সম্প্রতি দুই এলপিজি পরিবেশক ও তিনজন খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, তারা বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে এলপিজি সিলিন্ডার কিনছেন। একইসঙ্গে পরিবহনেও তাদের বাড়তি খরচ হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল এক অনুষ্ঠানে এলপিজি বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে স্বীকারও করেছেন। প্রয়োজনে ডিলারদের লাইসেন্স বাতিলের হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
আগস্টে সরকার সয়াবিন তেল ও চিনির দাম কমায়। সয়াবিন তেল ও চিনির দাম প্রতি লিটার ও কেজিতে ৫ টাকা কমিয়ে যথাক্রমে ১৭৪ টাকা ও ১৩৫ টাকা হয়েছে।
শুক্রবার রাজধানীর দুটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খোলা চিনি প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এবার দেখে নেওয়া যাক সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়ার অবস্থা।
২০১৫ সালে সরকার সিএনজিচালিত অটোরিকশার জন্য দৈনিক জমার সঙ্গে ভাড়ার হার, কিলোমিটার প্রতি ভাড়া, বিরতির ক্ষেত্রে প্রতি মিনিটের ভাড়া ও যেকোনো দূরত্বে যাত্রী পরিবহনের জন্য ন্যূনতম ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়।
এরপর থেকে প্রতি ঘনমিটারে সিএনজির দাম ৮ টাকা বাড়লেও সরকার ভাড়ার সঙ্গে সেই দাম সমন্বয় করেনি। তাই সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় কোনো কাজ হচ্ছে না।
বর্তমানে মিটারে যেতে ইচ্ছুক, এমন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে ডেইলি স্টার অন্তত সাতজন অটোরিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলেছে।
১৫ বছর ধরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছেন আনোয়ার হোসেন। ডেইলি স্টারকে আনোয়ার জানান, তিনি সরকার নির্ধারিত হারে নয়, গাড়ির মালিকের চাহিদা অনুযায়ী দৈনিক জমা দিচ্ছেন।
'আমার পক্ষে সরকারের নির্ধারিত ভাড়া অনুসরণ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করলে আমার পক্ষে পরিবার নিয়ে এই শহরে টিকে থাকা সম্ভব হবে না', বলেন তিনি।
সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী বহন না করা ও মিটার না থাকায় ট্রাফিক পুলিশ অনেক সময় জরিমানা করলেও আনোয়ার সেই ঝুঁকি নিয়েই অটোরিকশা চালাচ্ছেন।
সব ধরনের সম্পত্তি হস্তান্তর চুক্তি, ইজারা চুক্তি ও হলফনামার মতো দ্বিপাক্ষিক কাজের জন্য ব্যবহৃত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের দরও নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
কিন্তু চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম হওয়ায় নির্ধারিত দামে স্ট্যাম্প কিনতে পারছেন না কেউ। গ্রাহকদের নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি অর্থ দিয়ে এই স্ট্যাম্প কিনতে হয়।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে শিরায় দেওয়া স্যালাইনের দাম এখন ১৩০ থেকে ১৭০ টাকা, অথচ এর সর্বোচ্চ দাম লেখা আছে ১০০ টাকা।
তবে এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে আন্তজেলা ও দূরপাল্লার বাসের ভাড়ার ক্ষেত্রে। যাত্রী স্বল্পতার কারণে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম নেন বাস মালিকরা।
কিন্তু ঈদের আগে আদায় করা হয় বাড়তি ভাড়া।
মহাখালী বাস টার্মিনালে কথা হয় অনন্যা পরিবহনের ব্যবস্থাপক শামীম খানের সঙ্গে। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যাত্রী কম থাকায় আমরা কম দামে টিকিট বিক্রি করতে বাধ্য হই।'
ঘটনাগুলোর মাধ্যমে এটিই প্রমাণিত হয় যে, চাহিদা ও সরবরাহ নীতিই তার পথ খুঁজে নেবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজার তার নিজস্ব গতিতে চলে। এটি তিনটি জিনিসের মাধ্যমে চালিত হয়—সরবরাহ, চাহিদা ও প্রত্যাশা। সরকার চাইলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।'
বাংলাদেশে তেল, চিনি ও ডিম সরবরাহের জন্য রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি।
'স্বাভাবিকভাবেই ওই কোম্পানিগুলোর ব্যবসা একচেটিয়া হয়ে উঠেছে', বলেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, পাড়ার ছোট দোকান বা বাজারের বিক্রেতাদের ওপর নজরদারি না করে সরকারের উচিত বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর ওপর নজরদারি করা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'আর বাকি সব কিছুর দাম চাহিদা ও সরবরাহ নীতির ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।'
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের উচিত বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙার দিকে নজর দেওয়া। যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে এই সিন্ডিকেট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।'
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের ভাষ্য, 'সরকারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেঁধে দেওয়ার বর্তমান উদ্যোগ কার্যকর হবে না। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে স্বাভাবিক বা বিকল্প উপায়ে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে।'
Comments