শ্রমিক শোষণ বন্ধ করে ঢেলে সাজানো হোক চা শিল্প
বকেয়া মজুরি পরিশোধ নিয়ে প্রায় সাত সপ্তাহ ধরে উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের (এনটিসি) মালিকানাধীন ১২টি চা-বাগানের প্রায় ১২ হাজারের বেশি শ্রমিক। গত ১২ আগস্ট শ্রমিকদের ৫৯৫ টাকা করে দেওয়া হয়, যা তাদের সাপ্তাহিক মজুরির অর্ধেক। এরপর ২৫ সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত তারা কেউ কোনো মজুরি পাননি। ২৫ সেপ্টেম্বর তাদের সেই আগের বারের মতো ৫৯৫ টাকাই দেওয়া হয়। শ্রমিকদের জন্য এমন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক, কেননা আগামী ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হবে হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা। তারপরও শ্রমিকেরা বাগানের কাজ বন্ধ করেননি।
কাজ বন্ধ না হলেও বাগান কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখতে কারখানার গুদাম থেকে উৎপাদিত চায়ের চালান বাইরে পাঠানো বন্ধ রেখেছে শ্রমিকরা। এ নিয়ে এনটিসি কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর গত ১ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় কোম্পানির সবচেয়ে বড় বাগান পাত্রখোলা টি এস্টেট থেকে দুটি এবং বাকি ১১টি থেকে একটি করে চালান ছাড়েন শ্রমিকরা। বিনিময়ে ওই দিনই এক সপ্তাহের মজুরি পান তারা, এমনটিই নিশ্চিত করেন পাত্রখোলা চা-বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি শিপন চক্রবর্তী। এখন এনটিসি কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রমিকদের দাবি, দুর্গা পূজা শুরুর আগেই সব বকেয়া এবং বোনাস পরিশোধ করা হোক, না হলে গুদাম থেকে বাকি চালান ছাড়া হবে না।
এনটিসির বাগানগুলোতে এখন যে পরিস্থিতি, তার জন্য দায়ী সরকার ও রাজনৈতিক দূষণ। কোম্পানিজ অ্যাক্ট, ১৯১৩ এর অধীনে ১৯৭৮ সালে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে গঠিত হয় এনটিসি। এতে সরকারের শেয়ার ৫১ শতাংশ এবং বাকি ৪৯ শতাংশের লেনদেন হয় ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে সাধারণ জনসাধারণের জন্য। কোম্পানির ১২টি বাগানের মধ্যে সাতটি মৌলভীবাজার, চারটি হবিগঞ্জ ও একটি সিলেটে অবস্থিত।
স্বাধীনতার পর এনটিসির বাগান সরকারি মালিকানায় চলে যায়। ভৌগলিক অবস্থান চা চাষের উপযোগী হলেও লাভের মুখ খুব একটা দেখতে পারেনি এই বাগানগুলো। বাগানগুলোর ব্যবস্থাপনা যে ভালো নয়, তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চা গাছ এবং ছায়াবৃক্ষের অবস্থা দেখে বোঝা যায়। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে কোম্পানির লোকসান ছিল ২৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় এত সমস্যা অনেকাংশেই রাজনীতির কারণে। সমস্যা আরও ঘনীভূত হয় গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনীতির আকস্মিক পট পরিবর্তনের পর। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পড়ে। জানা যায়, পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, বর্তমানে পলাতক শেখ কবির হোসেন সম্পর্কে শেখ হাসিনার আত্মীয়।
চা-শ্রমিক এবং তাদের একমাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন একত্রে এনটিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি চালিয়ে যাচ্ছে। এতকিছুর পরও শ্রমিকরা চরম ধৈর্যের সঙ্গে বাগান ও কারখানার কাজ অব্যাহত রাখছেন শুধু এই আশায় যে কর্তৃপক্ষ তাদের কথা রাখবে ও দুর্গা পূজা শুরুর আগেই তাদের বকেয়াসহ সব মজুরি পরিশোধ করবে।
এনটিসির সামনে এখন কঠিন পথ। চা-বাগানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কাছে কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ৩৮০ কোটি টাকা। চলতি বছর ব্যাংকটির কাছে আরও ১৫০ কোটি টাকা ঋণ চাইলেও ব্যাংক অনুমোদন দেয় ৮৬ কোটি টাকা, যা ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে—এমনটিই জানান তিনি। উল্লেখ্য, ঋণ পরিশোধের নিয়ম অনুযায়ী, নিলামে চা বিক্রি থেকে আয়ের একটি অংশ সরাসরি চলে যায় কৃষি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ও আরেকটি অংশ পায় মালিকরা। এমন পরিস্থিতিতে দাবি আদায়ের জন্য শ্রমিকদের কারখানার গুদাম থেকে চালান বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
এনটিসি বাগানের এতসব বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসার সাধারণ উদাহরণ হলেও এরকম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি আরও অনেক প্রাইভেট কোম্পানি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানেও দেখা যাচ্ছে, যা চা-শ্রমিকদের গভীর সংকটে ফেলেছে। এর বড় উদাহরণ হবিগঞ্জ জেলার ইমাম অ্যান্ড বাওয়ানী টি এস্টেট। চা-বাগান সংশ্লিষ্ট সেই একই সরকারি কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, বাগান দুটি দীর্ঘদিন ধরেই সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে ইমাম চা-বাগান গত বছরের অক্টোবরে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আর, বাওয়ানী চা-বাগানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব চলে যায় শ্রীমঙ্গলের বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালকের হাতে। এতসব অব্যবস্থাপনার ফলে উপ-পরিচালকের পক্ষে বাগান চালানো কঠিন। পাশাপাশি বাগান দুটির শ্রমিকদেরকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা চা-বাগান দুর্বল ব্যবস্থাপনার আরেকটি উদাহরণ। সরকারি কর্মকর্তা জানান, এই বাগানের প্রায় এক হাজার ৬০০ জনের মতো শ্রমিক ১২ সপ্তাহ ধরে কোনো মজুরি পাচ্ছেন না। বাগানের মালিক লন্ডনে থাকেন এবং বাগানটি তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন—এমনটাই বলা হচ্ছে। যদিও শুধুমাত্র শ্রমিকদের কারণে উৎপাদন এখনো কিছুটা অব্যাহত আছে। সরকারি ওই কর্মকর্তা বলেন, ৫০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়ে বর্তমানে বাগানের মালিক গভীর সংকটে আছেন।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ৭৯টি চা-বাগানের অবস্থা বেশ খারাপ। এসব বাগান কয়েক মাস ধরে প্রভিডেন্ট ফান্ডে (পিএফ) অর্থ জমা দিচ্ছে না। বিল পরিশোধ না করায় অনেক চা-বাগানে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। ফলে নিজেদের কারখানা চালাতে না পেরে তাদের সবুজ চা-পাতা বিক্রি করে দিচ্ছে অন্য বাগানের কাছে।
অনেক বাগান মালিকের অভিযোগ, চায়ের নিম্নমুখী বাজার দর ও ঊর্ধ্বমুখী উৎপাদন খরচ তাদের সংকটের অন্যতম কারণ। প্রতি বছর সরকারের চা চাষ এলাকা সম্প্রসারণ নীতির কারণে চায়ের উৎপাদন বেড়ে চলেছে।
তবে, ভালো চা-বাগানেরও নজির আছে। এসব বাগান কর্তৃপক্ষ ভালোভাবেই তাদের বাগান পরিচালনা করছে, বর্তমান মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা কাঠামোর মধ্যে থেকেই তাদের শ্রমিকদের ভালো যত্ন নিচ্ছে এবং ভালো মুনাফাও করছে। ইস্পাহানি টি লিমিটেড এমনই এক বাগানের উদাহরণ। এই কোম্পানির চারটি বাগান রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম মৌলভীবাজারের জেরিন টি এস্টেট। কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশে একরপ্রতি গড় উৎপাদন যেখানে এক হাজার ৬০০ কেজির মতো, সেখানে জেরিন চা-বাগানের একক উৎপাদন তিন হাজার কেজি। ইস্পাহানির চারটি বাগানে প্রতি একরে গড়ে উৎপাদন হয় দুই হাজার ৫০০ কেজি ও বিক্রি থেকে আয়ও হয় ভালো। আরও জানা যায়, জেরিন চা-বাগানের লেবার লাইনের অধিকাংশ বাড়িই পাকা। ইস্পাহানির অন্যান্য বাগানেও লেবার লাইনের বাড়ির অবস্থা বাকি অনেক কোম্পানির বাগানের তুলনায় বেশ ভালো। ইস্পাহানি কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের বাগানে চা-শ্রমিকরা মজুরিসহ অন্যান্য সব সুবিধা ঠিকভাবেই পায়।
চা-শিল্পের বৃহত্তর স্বার্থ এবং চা-শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য ভালো পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমাজ থেকে বৈষম্য ও অসমতা দূরীকরণের যে অঙ্গীকার নিয়েছে, তার প্রতিফলন চা-শিল্প এবং চা-শ্রমিকদের ব্যাপারেও হওয়া উচিত। প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার চা-শ্রমিক এবং তাদের পরিবার—সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখের মতো মানুষ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া এই চা-শিল্পে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চরম বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে।
প্রথমত, চা-শিল্পের বিশেষ করে বাগানগুলোর অবস্থার ভালো মানচিত্রায়ণ প্রয়োজন। ভালো বাগান ও খারাপ বাগান চিহ্নিত করে সেসবের কারণগুলো বিশ্লেষণ করা দরকার এবং কোনো বাগান অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম করে যাতে নিষ্কৃতি না পায়, তার জন্য জোর সুপারিশ প্রণয়ন জরুরি। চা-শিল্পের সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাদের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চালাতে হবে এবং তাদেরকেও দায়বদ্ধ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও যে চা-শ্রমিকরা নাগরিকের সমান সুযোগ ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত থেকেছে বহুকাল, তাদের সার্বিক কল্যাণে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। শুরু করতে হবে ন্যায়সঙ্গত ও সম্মানজনক মজুরি নির্ধারণের মাধ্যমে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ২০২২ সালের আগস্টে চা-শ্রমিকের জন্য যে ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, তা মোটেই ন্যায্য ছিল না। অভিযোগ আছে যে, তিনি মালিকদের নির্দেশনামতো মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এবং তার হস্তক্ষেপ ছিল রাজনৈতিক, যখন নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে মজুরি কাঠামো নির্ধারণে ব্যর্থ হওয়ার সবরকম ব্যবস্থা করা হয়। এখন সময় এসেছে চা-শিল্পকে ঢেলে সাজিয়ে শ্রমিকের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করার।
চা-শ্রমিকের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করতে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালায় তাদের প্রতি বৈষম্য। তা ছাড়া মালিকরা প্রতিনিয়ত শ্রম আইনের যেসব ধারা লঙ্ঘন করে চলেছেন, তা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। মালিকরা শ্রম আইনের যেসব ধারা নিয়মিতভাবে লঙ্ঘন করেন, তা বিভিন্ন গবেষণা ও লেখালেখিতে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রমিক, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী ট্রেড ইউনিয়ন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করলে এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিতভাবে জানা যাবে। যেসব সরকারি সংস্থা শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত তারা যাতে সততার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করে তা নিশ্চিত করা যেকোনো সরকারের জন্য একটি পরীক্ষা।
চা-শ্রমিক যাদের অধিকাংশই বাঙালি নন, হিন্দু ও আদিবাসী, অনেকটাই অদৃশ্য ও শক্তিহীন। ব্রিটিশ আমল থেকে মজুরি বঞ্চনা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাদেরকে একটি দুর্বল জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রেও তারা অনেক পিছিয়ে আছেন। কেবল সমান সুযোগই তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। বর্তমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বাড়তি কিছু সুবিধার দাবি তারা করতেই পারেন। তাদের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের বড় দায়িত্ব রয়েছে।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক
Comments