ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের দাবি

‘মেয়র তাপসের তথ্য সঠিক না, প্রমাণ দিতে হবে’

ডেঙ্গুতে রেকর্ড আক্রান্ত ও মৃত্যুর বছর ২০২৩ সালে 'সাফল্যের সঙ্গে' এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণের যে দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, তা সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড হয়েছে ২০২৩ সালে। ঢাকায় ৯৮০ জন এবং সারা দেশে ১ হাজার ৭০৫ জন মারা যায় বছরটিতে। অথচ মেয়র তাপসের দাবি 'মশা নিয়ন্ত্রণের কারণে' ২০১৯ সালের তুলনায় গত বছর 'ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অর্ধেক কমেছে'।

গত বুধবার মালিবাগ মোড় সংলগ্ন উড়ালসেতুর নিচে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের গণশৌচাগার উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই দাবি করেন মেয়র।

পরে এ সংক্রান্ত ডিএসসিসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের দাবি করে তিনি বলেন, 'সফলতার সঙ্গে এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি বলেই ২০২৩ সালে উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়ে ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগী ছিল ১ লক্ষ ১৩ হাজার।'

ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪২ হাজার কম ছিল বলেও দাবি করেন তাপস।

এ ছাড়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া ডেঙ্গু রোগীর তথ্য 'সঠিক নয়' বলেও দাবি করেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের সঙ্গে।

এই বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, মশা নিয়ন্ত্রণে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন যে কার্যক্রম দরকার, বিশেষায়িত ও প্রশিক্ষিত জনবল দরকার, তা এখনো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোথাও নেই। এ অবস্থায় কোন এলাকায় মশার ঘনত্ব কতটুকু কমল-বাড়ল তা কেবল খালি চোখে দেখে বোঝা সম্ভব না।

আবার যে প্রক্রিয়ায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করা হয় সেখানেও গলদ আছে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ যদি মশার বিস্তারসহ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফলতার দাবি করেন তাহলে তা 'বিপজ্জনক'। কারণ এমন দাবি প্রকৃত চিত্রকে আড়াল করে দিতে পারে; যা প্রাণঘাতী এই রোগ নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্মূলের পথটিকে আরও কঠিন করে তুলবে।

এ বিষয়ে ডা. মুশতাক হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, '(মেয়র তাপসকে) এটা প্রমাণ করতে হবে যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য ভুল। আর সিটি করপোরেশন যে তথ্য দেখিয়েছে, সেটা যদি সত্য হয়েও থাকে, তাহলেও এটা কখনো সাফল্যের পরিচায়ক না।'

এর কারণ ব্যাখ্যা করে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, '২০১৯ সালের আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর গড় যে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল, তার তুলনায় গত ৪ বছরে এর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ‍সুতরাং তিনি (মেয়র তাপস) যে তথ্য দিচ্ছেন সেটা ঠিক না। আর তিনি তার তথ্যের সাপেক্ষে যদি প্রমাণ দিতে না পারেন সেটা খুব দুঃখজনক হবে। ভুল তথ্য দেওয়া ঠিক না।'

বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর যে হার তা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নেই জানিয়ে ডা. মুশতাক আরও বলেন, 'এর জন্য কেবল মেয়ররা দায়ী নন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়—সবারই দায় আছে। যখন আমরা মৃত্যুকে মিনিমাম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারব, তখন এটাকে সাফল্য বলা যাবে। সফল বলার সময় এখনো আসেনি।'

এই ধরনের দাবির নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও কথা বলেন মুশতাক হোসেন। তার ধারণা, এমন 'ভুল' দাবির কারণে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজে যুক্ত সংশ্লিষ্ট করপোরেশন কর্মীদের মধ্যে একটা 'কৃত্রিম আত্মতৃপ্তির ভাব' আসতে পারে। তিনি বলেন, 'ডেঙ্গুর মৌসুম মাত্র শুরু হলো। মৌসুমের আগেই তো আমরা অনেক রোগী দেখলাম। সামনে আরও অনেক আক্রান্ত ও মৃত্যুর আশঙ্কা আছে।'

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মেয়রের সাফল্যের দাবি প্রসঙ্গে ডা. মুশতাকের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মূল কাজটা হলো এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ। এর জন্য এন্টোমোলজিক্যাল (কীটতত্ত্ব সংক্রান্ত) ক্যাপাসিটি লাগে। এন্টোমোলজি ছাড়া শুধু এডিস কেন, কোনো মশাই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।'

তিনি বলেন, 'আমরা যদি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল কর্মসূচি দেখি, কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচি দেখি, সেখানে অনেক এন্টোমোলজিস্ট (কীটতত্ত্ববিদ), এন্টোমোলজিস্ট টেকনিশিয়ান ও প্রশিক্ষিত মাঠকর্মীরা যুক্ত। তারা পরিকল্পনা করেন, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, জরিপ করেন। যে কারণে ওই জায়গাগুলোতে আমরা সফল।'

কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণের কাজে সিটি করপোরেশনের যারা যুক্ত আছেন তাদের মধ্যে এই 'এন্টোমোলজিক্যাল ক্যাপাসিটির' ঘাটতি আছে বলে মন্তব্য করেন বে-নজীর আহমেদ। বলেন, 'এটা মূলত করা হয় নিরক্ষর বা সামান্য পড়ালেখা জানা মশক নিধন কর্মীদের দ্বারা। যারা এটা তত্ত্বাবধান করেন, তারাও সাধারণ ডিগ্রির। কিন্তু কেউ এন্টোমোলজিস্ট না। তাই এখানে একটা ফাঁক থেকে যায়। এ অবস্থায় আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি কিনা, সেটা তো বোঝারই উপায় নেই।'

এমন পরিস্থিতিতে 'ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি—এমন দাবি করা যৌক্তিক হতে পারে না, সঠিকও হতে পারে না' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ ছাড়া, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি ও এই রোগে মৃত্যুর তথ্য নিয়েও কথা বলেন বে-নজীর আহমেদ। বলেন, 'ঢাকা শহরে যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা কোন ওয়ার্ডের, কোন সিটি করপোরেশনের আওতায় এগুলোর জানার জন্য আলাদা কোনো ইউনিট নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কিছু তথ্য আসে। কিন্তু এটা আসলে কোনো এলাকার প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তোলে না। তাই আমরা যতসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী দেখি, তারচেয়ে অনেকসংখ্যক রোগী আমাদের কমিউনিটিতে থাকে।'

এ অবস্থায় কোনো সিটি করপোরেশনই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দাবি করার মতো অবস্থায় আসেনি বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক। তার ভাষ্য, 'পরিস্থিতি বরং উল্টো। এই চ্যালেঞ্জটা সামনের দিকেও থাকবে এবং ঢাকা সিটিতে যারা আক্রান্ত হবেন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। কারণ তারা এর আগে একাধিক স্ট্রেইন (ধরন) দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন।'

বে-নজীর আহমেদ আরও বলেন, 'সাদা চোখে দেখে এমন মন্তব্য করলে বরং আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যহত হবে। বেশি ঝুঁকি তৈরি করবে।'

বিষয়টি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের পর্যবেক্ষণ হলো, 'ডেঙ্গু একটা অসুখ; যা কাউকে খাতির করে না। কে রাজা, কে প্রজা, কে মন্ত্রী, কে গরীব, কে বড়লোক—সেটা দেখে না। সুতরাং আগে এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে হবে। তাই যারা এটা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন, তারা যদি এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে না পারেন, বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করতে থাকেন, তাহলে সত্যিকারের সফলতা আসবে কীভাবে?'

দক্ষিণের মেয়রের বক্তব্যের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। এদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটির রোগী ছিলেন ৫১ হাজার ৭৬২ জন। সে বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিলেন ১৭৯ জন। ঢাকায় কত জন মারা গিয়েছিলেন, আলাদা করে সেই তথ্য নেই।

এর চার বছর পর ২০২৩ সাল ডেঙ্গু ভয়ংকর হয়ে উঠে। সেবার সারা দেশে রেকর্ড ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ রোগী শনাক্ত হন। এদের মধ্যে ঢাকার ছিলেন ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন। অর্থাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ঢাকায় রোগী ছিল দ্বিগুণেরও বেশি।

আবার মৃত্যুর দিক দিয়েও ২০২৩ সাল ছিল বেদনাবিধুর। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হিসাবে সারা দেশে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয় ওই বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। ঢাকায় সংখ্যাটি ছিল ৯৮০।

অর্থাৎ ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে যত মানুষ মারা গিয়েছিল, ২০২৩ সালে তার পাঁচ গুণ মারা যায় কেবল ঢাকা শহরেই।

গত ১৫ মে, বুধবার মেয়র তাপস যখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের দাবি করেন, ওই দিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিন জনের মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যাদের সবাই ঢাকা দক্ষিণ সিটির বাসিন্দা।

অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে, মৌসুম শুরুর আগেই সারাদেশে চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৪৫ জনে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৩২ জন।

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago