ডেঙ্গু রোগী: হাসপাতালের বিছানা মেঝে বারান্দা করিডোর কোথাও জায়গা মিলছে না
শনিবার দুপুর ২টা। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় তলার ডেঙ্গু ওয়ার্ডে পা ফেলবার জায়গা নেই প্রায়। এরমধ্যেই দেখা গেল ১০ বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভর্তির কাগজপত্র হাতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন মানিকগঞ্জ থেকে আসা এক ব্যক্তি।
কথা বলে জানা গেল, ভর্তির সময়েই নুরুল হক নামে ওই বাবাকে বলে দেওয়া হয়েছে নতুন রোগীর জন্য এই হাসপাতালে কোনো বেড খালি নেই। তাই মেয়েকে এখানে রাখতে হলে মেঝেতেই বিছানা ফেলে থাকতে হবে। কিন্তু আধঘণ্টার চেষ্টায় সে জায়গাটুকুও জুটল না তাদের। শেষমেষ তাদের ঠাঁই হলো লিফটের পাশে কোণাকৃতির ছোট্ট একটু পরিসরে।
এখানকার চিকিৎসকদের ভাষ্য, দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় এখন ঢাকার পাশাপাশি আশপাশের জেলার রোগীদের চাপও সামলাতে হচ্ছে তাদের। তাই গত এক সপ্তাহ ধরে এখানে কখনোই রোগীর সংখ্যা ৫০০'র নিচে নামেনি।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুসারে, গতকালও এই হাসপাতালে ৫০১ জন রোগী ভর্তি ছিল। এরমধ্যে আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা যান ২ জন রোগী। ছাড়পত্র পান ৭৯ জন। নতুন ভর্তি হন ৯৫ জন।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল দুপুরেই হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যান্ড কেয়ার সেন্টার চালু করে মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য চালু হয় নতুন অ্যাফারেসিস (Apheresis) মেশিন।
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন সিরিয়াস কোনো রোগীকে সরাসরি আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নেওয়া আগে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে রাখা হবে। এখানে নতুন ৬টি আইসিইউ বেড ও ৬টি এইচডিইউ বেড আছে।'
মো. নিয়াতুজ্জামানের কাছ থেকে জানা যায়, গতকালও হাসপাতালের ৪০টি আইসিইউ বেডের সবগুলো ছিল ডেঙ্গু রোগীতে পূর্ণ।
এদিন তৃতীয় তলার নারী ওয়ার্ডে দেখা যায়- মেঝে, বারান্দা, সিঁড়ির পাশসহ একটু-আধটু ফাঁকা জায়গাও রোগীতে ঠাসা। কেবল চাটাই বিছিয়ে থাকতে দেখা গেল অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের। ঝোলানোর স্ট্যান্ড না থাকায় কায়দা করে কোনোমতে উঁচু কোনো জায়গায় কারও কারও স্যালাইন ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
দশম তলার পুরুষ ওয়ার্ডেও ছিল একই অবস্থা।
জায়গা নেই শিশু হাসপাতালেও
গতকাল আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের দরজায় পৌঁছানোর আগেই শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। ভেতরে ঢুকতেই অভিভাবকদের চোখেমুখে দেখা গেল উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ছাপ।
সেখানে কান্নারত ৪ বছরের অনীক নন্দী নামের এক শিশুর বাবা জানালেন, গত ৫ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন তারা। মাঝে বাচ্চার প্লাটিলেট ৬০ হাজারে নেমে এসেছিল। এখন অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে।
৭ বছরের আরেক শিশু মাঈশা মুমতাহা বায়না করছিল বাইরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু স্যালাইন চলার কারণে তাকে বাইরে নেওয়ার উপায় ছিল না।
এই ওয়ার্ডে উপস্থিত হাসপাতালের এক চিকিৎসক ডেইলি স্টারকে জানালেন, ওই মুহূর্তে হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১০০'র বেশি। ডেঙ্গু রোগীদের জায়গা দিতে গিয়ে অন্য অনেক গুরুতর রোগীদের জায়গা কমে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে অনেককে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তারা।
ওই চিকিৎসকের কথার সত্যতা পাওয়া গেল নিচতলার জরুরি বিভাগের সামনে গিয়ে। ১৫ মিনিটের মতো অবস্থানে সেখান থেকে অন্তত ৩ শিশুকে ফিরিয়ে দিতে দেখা গেল চিকিৎসকদের।
এদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ থেকে ১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে আসা মোবারক হোসেন ডেইলি স্টারকে বললেন, 'ডাক্তার বলছে রোগীর যে অবস্থা তাতে আইসিইউতে রাখা ছাড়া উপায় নেই। এইখানে আইসিইউ বেড খালি নাই। এখন কোথায় যাব বুঝতে পারতেছি না।'
ডিএনসিসি হাসপাতালে রোগীর চাপ 'কিছুটা কম'
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় গত বছরের মতো এবারও মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছে রাজধানীর মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতাল।
জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালটিকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গতকাল এই হাসপাতালে কথা হয় ধুপখোলা থেকে আসা রীনা বেগমের সঙ্গে। তার ১৪ বছর বয়সী মাদরাসা পড়ুয়া ছেলে তখন আইসিইউতে।
রীনা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জ্বর শুরুর প্রথম ২ দিনে এলাকার ডাক্তাররে দেখাইছি। প্রথমবার টেস্টে ডেঙ্গু ধরা পড়ে নাই। পরে যখন ধরা পড়ল তখন ছেলের অবস্থা খারাপ। এইখানে আনতেই আইসিইউতে রাখছে।'
এই হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানালেন, এই মুহূর্তে হাসপাতালটিতে ২৯০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। গত সপ্তাহের মাঝামাঝি পর্যন্ত কোনোদিন রোগীর সংখ্যা ৪০০'র নিচে নামেনি। শুক্রবার আইসিইউতে ১ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন।
ওই চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ হলো, যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগ ঢাকার বাইরে থেকে আসা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব খারাপ অবস্থায় তাদের এখানে আনা হচ্ছে। ফলে তাদের তেমন কিছু করার থাকছে না।
ডেঙ্গুতে এক বছরে এত মৃত্যু কখনো দেখেনি বাংলাদেশ
এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়েছিল বর্ষা মৌসুমের আগেই। ভরা বর্ষায় জুলাই মাসে তা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়।
জুলাই মাসের ৩১ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন রোগী, মৃত্যু হয় ২০৪ জনের।
সব মিলিয়ে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৯৬৮ জনে। তাদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৫২৩ জন ঢাকার।
এরমধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও ১০ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর খবর জানায়। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট ৩০৩ জন মারা গেলেন।
ডেঙ্গুতে এক বছরে এত মৃত্যু আর কখনও দেখেনি বাংলাদেশ। এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে এক বছরে সর্বাধিক ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ বছরের মৃত্যু সংখ্যা সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছিল ২৮১ জনের এবং মোট আক্রান্ত ছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন।
২০১৯ সালে সারাদেশে রেকর্ড ১ লাখ ১ হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
এবারের ডেঙ্গু আরও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার কারণ জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেখা যাচ্ছে এবার ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের হার বেশি। ডেঙ্গুর মোট ৪টি ধরন আছে। আগের বছর কেউ একটি ধরনে আক্রান্ত হলে পরেরবার যদি ওই একই ধরনে আবার আক্রান্ত হন তাহলে তেমন ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু পরেরবার অন্য কোনো ধরনে আক্রান্ত হলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবার সেটাই বেশি ঘটছে।'
এ ছাড়া অনেক রোগীকে সংকটাপন্ন হয়ে ওঠার পর হাসপাতালে আনা হচ্ছে জানিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, 'মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পেছনে এটাও একটি কারণ হতে পারে।'
Comments