তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর উদ্বোধন কাল

এই সেতুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ১২ বছর। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/ স্টার

নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর উপজেলাকে বিভক্ত করেছে শীতলক্ষ্যা নদী। এই নদীর ওপর দিয়ে একটি সেতু ২ পাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। অবশেষে তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটছে। আগামীকাল সোমবার সকালে ভার্চুয়ালি বহুল প্রতীক্ষিত এই তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই সেতু কেবল জেলা সদর ও বন্দরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করবে না, দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্বও কমিয়ে আনবে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। 

সেতুটির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ১২ বছর। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১০ সালের নভেম্বরে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সদরের সৈয়দপুর থেকে বন্দরের মদনগঞ্জ এলাকা পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর দিয়ে একটি সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। প্রায় ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ বছরের মধ্যে এই প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতেই সময় লেগেছে অন্তত ৬ বছর।

২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করলেও কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। মাত্র ১ হাজার ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুটি নির্মাণে অতিরিক্ত সময় তো লেগেছেই, পাশাপাশি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ।

৬০৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সেতুটি নির্মাণে ৩৪৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছে সৌদি সরকার। বাকি অর্থ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সেতু নির্মাণ করেছে 'সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড' নামে একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শোয়েব আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৬ লেনের সেতুটি শিল্প ও বন্দর নগরী হিসেবে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে সড়কপথে সোনারগাঁ ও বন্দর উপজেলার সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। এ ছাড়া, ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে বিকল্প সড়ক যোগাযোগও তৈরি করবে এই সেতু। সেতুটি খুলে দেওয়ার পর দেশের ৩টি প্রধান জাতীয় মহাসড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-মাওয়া-খুলনা সরাসরি সংযুক্ত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হবে।'

'ফলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত হবে। এই সেতু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের সঙ্গে পদ্মা সেতুর দূরত্ব কমাবে অন্তত ৯ কিলোমিটার। এতে সময়ও সাশ্রয় হবে। সেতুটি সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসার ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে', যোগ করেন তিনি।

প্রায় ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ বছরের মধ্যে এই প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতেই সময় লেগেছে অন্তত ৬ বছর। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/ স্টার

জেলা সড়ক ও জনপথ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, 'এই সেতুর মাধ্যমে শুধু নারায়ণগঞ্জবাসীই উপকৃত হবে না, দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রামের যাতায়াতও খুব সহজ হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে মুন্সিগঞ্জ হয়ে শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে মদনপুর হয়ে চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে। এটি জাতীয় পর্যায়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেতু।'

সদর ও বন্দরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতলক্ষ্যা নদী জেলা সদরের সঙ্গে বন্দর ও সোনারগাঁ উপজেলাকে পৃথক করে রেখেছে। এই ২টি উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় কাঁচপুর (শীতলক্ষ্যা সেতু-১) হয়ে দীর্ঘ ৩০ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। এ ছাড়া, বন্দর উপজেলার মদনপুর থেকে মদনগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত ১৩টি খেয়াঘাট আছে। সাধারণ জনগণ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ এই ঘাটগুলো দিয়ে নদীপথে ঝুঁকিপূর্ণ জলযানে যাতায়াত করেন। তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু তাদের এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেবে।

নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার ধামগড় ইউপির বাসিন্দা শিমু আক্তার বলেন, 'সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নে আমার শ্বশুরবাড়ি। শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে প্রায় সময়ই বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাতায়াত করতে হয়। আমার ছেলে হাঁটতে পারে না। তাকে নৌকায় তুলতে আর নৌকা থেকে নামাতে অনেক কষ্ট হয়। সেতু চালু হয়ে গেলে গাড়ি দিয়েই যাতায়াত করা যাবে। নদীপথের ভোগান্তি পোহাতে হবে না।'

তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নামকরণ করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রয়াত সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাসিম ওসমানের নামে। ২২ দশমিক ১৫ মিটার প্রশস্ততার এই সেতুতে ধীরগতির গাড়ি (রিকশা-সাইকেল) চলাচলের জন্য আলাদা ২টি লেন রাখা হয়েছে। হেঁটে পারাপারের জন্য আছে ফুটপাত।

এদিকে, সেতু খুলে দেওয়া হলেও এখনই এর সুবিধা পাবেন না বলে মনে করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। তারা বলছেন, সেতুর পূর্বপাড় মদনগঞ্জ থেকে মদনপুরের ১১ কিলোমিটারের সড়কটি খুবই সংকীর্ণ। এই পথে প্রায় সময়ই যানজট লেগে থাকে। সেতুটি চালু হলে যানবাহনের চাপ বাড়বে, তাতে সড়কে যানজট আরও বাড়বে। সড়কটির প্রশস্ততা বাড়ানোর জন্য নারায়ণগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগ উদ্যোগ নিলেও কাজ শেষ হতে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

মদনগঞ্জ-মদনপুরে রুটের সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক জয়নাল আবেদীন বলেন, 'এমনেই এই রাস্তায় যানজট লাইগা থাকে। ব্রিজ উদ্বোধন করলে দুনিয়ার গাড়ি আইবো এই রাস্তায়। রাস্তার কাজ তো চলতেছে ধীরগতিতে। রাস্তা না হইলে ব্রিজের সুবিধা লোকজন পাইব না। উল্টা যানজট বাড়ব।'

এ বিষয়ে জেলা সড়ক ও জনপথ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, 'মদনগঞ্জ থেকে মদনপুর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ১৮ ফুট প্রস্থের রাস্তার প্রশস্ততা আরও ৬ ফুট বাড়ানোর কাজ চলছে। এটি একটি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা। আমরা দীর্ঘমেয়াদী হিসেবে ৬ লেনের রাস্তা করার পরিকল্পনা করেছি। যেহেতু ওটা করতে সময় লাগবে, সে কারণে এই মুহূর্তে সেতু উদ্বোধন হয়ে যাওয়ায় যে যানবাহনের চাপ বাড়বে তা সামাল দিতে রাস্তার প্রশস্ততা ৬ ফুট বাড়ানোর কাজ করছি। এই কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে।'

সেতুর পূর্বপাড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশাল স্থানজুড়ে শামিয়ানা টানিয়ে ৫ হাজার মানুষের আসন ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আনন্দ মিছিলেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বস্ত্র  ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক), নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান প্রমুখ।

জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেতুর পূর্বপাড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী, সিটি মেয়র, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানস্থলে এলইডি স্ক্রিন স্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সেতুটি উদ্বোধন করবেন।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

10h ago