বনমোরগের সন্ধানে
খাঁজকাটা বড় ঝুঁটি, মুখমণ্ডল ও ঠোঁটের নিচের লতিকার রঙ টকটকে লাল। পিঠের রঙ লাল-কমলায় মেশানো। ডানার পালক আবার তিনরঙা—লাল-কালো-সোনালি। ঘাড় থেকে সোনালি-হলুদ সরু পালক নেমে গেছে পিঠ বেয়ে।
একসময় চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের সব বন এবং সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়ানো এই সুদর্শন বনমোরগের সৌদর্য বর্ণনায় গানের দল সমগীত গেয়েছিল—'বনমোরগের রূপে আমার মন কাড়িল সে/বনের কুমার মনে আজি পালক মেলেছে'।
গভীর জঙ্গলে হঠাৎ দূর থেকে দেখা কিংবা শিকারির হাতে ধরা পড়া বাংলাদেশের এই আবাসিক 'পাখির' রূপে মুগ্ধ হওয়ার এমন অনেক গল্প শোনা গেলেও একে পোষ মানানোর কোনো ঘটনা এতদিন পর্যন্ত জানা যায়নি।
সেই বনমোরগকে পোষ মানিয়ে অবাক করে দিয়েছেন বান্দরবান সদর উপজেলার দুই নম্বর কুহালং ইউনিয়ন ও রাজবিলা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রাম মেওয়া পাড়ার হ্লা শোয়ে অং মারমা (৪০) ও শোয়ে মে চিং (৩৬) মারমা দম্পতি। আর তারা কেবল পোষ মানিয়েই ক্ষান্ত হননি, রীতিমতো বাড়িতে বনমোরগের খামারও তৈরি করেছেন। এ জন্য নিজেদের বাড়ির চারপাশে বেড়া দিয় বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগিয়ে তৈরি করেছেন বনের পরিবেশ।
এই বনমোরগ বনমুরগি বা জংলি মুরগি নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Red Jungle Fowl। Phasianidae পরিবারের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Gallus gallus murghi.
পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ আ ন ম আমিনুর রহমান তার একটি লেখায় জানাচ্ছেন, এমনিতে বনমোরগ সহজে চোখে পড়ে না। সাধারণত ডাক শুনে এদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এককালে দেশের প্রায় সব বনজঙ্গলেই দেখা যেত। বাংলাদেশের বাইরে ভারত, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে দেখা যায়। ব্যাপক শিকারের কারণে পাহাড়ি বনে এরা এখন হুমকির মুখে। খুব ভোরে ও সন্ধ্যার আগে মাটি থেকে কুড়িয়ে বিভিন্ন শস্যদানা, ঘাসের গোড়া, কীটপতঙ্গ, ফল ইত্যাদি খেয়ে থাকে। রাত কাটায় উঁচু গাছের ডালে বা বাঁশঝাড়ে। ভালো উড়তে পারে। কক্ কক্ শব্দ করে ডাকে।
বনমোরগের খামারের সন্ধানে
কুহালং ইউনিয়নের রাবারবাগান এলাকায় হ্লা শোয়ে অং মারমা (৪০) ও শোয়ে মে চিং (৩৬) মারমা দম্পতির গড়ে তোলা বনমোরগের খামারে পৌঁছাতে প্রথমে বান্দরবান সদর থেকে মোটরসাইকেলে যেতে হবে অর্ধেক পথ। এরপর প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছানো যাবে মেওয়া পাড়ায়।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে কথা হয় এই দম্পতির সঙ্গে। মাতৃভাষায় তারা জানান প্রায় পাঁচ বছর আগে গহীন পাহাড়ে জুম কাটতে যাওয়ার পথে ছয়-সাতটি ডিমসহ একটি বনমোরগের বাসা দেখতে পান তারা। সেখান থেকে ৩টি ডিম নিয়ে এসে ঘরে দেশি মুরগির সঙ্গে 'তা' দিয়ে বাচ্চা ফোটাতে দেন। একটা ডিম পচে গেলেও বাকি দুটো ডিম থেকে একটি মোরগ ও একটি মুরগি বাচ্চা জন্ম নেয়।
এরপর বাচ্চা দুটি দেশি মুরগীর বাচ্চাদের সঙ্গে বড় হতে থাকে। একদিন তারা দেখতে পান, বনমোরগের বাচ্চা দুটো অসুস্থ হয়ে ঘাসের ওপর পড়ে আছে। এ সময় বাচ্চা দুটোকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন তারা। পাহাড়ি লতাপাতা থেকে শুরু করে বনের বিভিন্ন ধরনের ভেষজ ওষুধ খাওয়াতে শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই বাচ্চা দুটো স্বাভাবিক হচ্ছিল না।
এভাবে তিন-চার ঘণ্টা কাটার পর তারা এগুলোকে শক্ত ধানের দানা ও পাশের জঙ্গল থেকে ধরে আনা ডিমসহ পিঁপড়া ও নানা ধরনের পোকামাকড় খাওয়াতে শুরু করেন। এসব খাবার খেয়ে বাচ্চা দুটো খানিকটা সুস্থ হয়ে হাঁটাচলা শুরু করে।
তখন তারা বুঝতে পারেন, দেশি মুরগির মতো নরম ভাতের সঙ্গে ভুসি মিশিয়ে খাওয়ালে ওরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর থেকে বনমোরগের জন্য নিয়মিত ঘাস ফড়িং, পোকামাকড় ধরে এনে খাওয়াতে শুরু করেন। পাশাপাশি খেতে দেন ধানবীজ। একসময় বাচ্চা দুটো বড় হয়ে ডিম পেড়ে বাচ্চা দিতে শুরু করে।
হ্লা শোয়ে অং মারমার কাছ থেকে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে প্রায় এক থেকে দেড়শ'র মতো বনমোরগ জন্ম নিয়েছে তার খামারে। বর্তমানে খামারটিতে ২২টি পূর্ণ বয়স্ক মুরগি, ১৩টি মোরগ, ২টি শিকারি মোরগ, ১৭টি বাচ্চাসহ তিনটি মা মুরগি রয়েছে। এ ছাড়া নয়টি ডিম নিয়ে 'তা' দিচ্ছে আরেকটি মুরগি।
পূর্ণ বয়স্ক প্রতিটি মোরগ ৩ হাজার টাকা এবং মুরগি এক থেকে দেড় হাজার টাকায় করে বিক্রি করেন তারা।
এ বছর আটটি মুরগি ও পাঁচটি মোরগ বিক্রি করেছেন শোয়ে অং দম্পতি। এ ছাড়া বেশ কিছু মুরগির অর্ডার পেয়েছেন।
প্রতিটি মুরগির ওজন কতটুকু জানতে চাইলে হ্লা শোয়ে অং বলেন, 'এদের ওজন দেশি মুরগির মতো নয়। পূর্ণ বয়স্ক একটি বনমোরগের ওজন সর্বোচ্চ ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম, আর মুরগির ওজন হয় ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম। তবে মা মুরগির পেটে ডিম থাকলে ওজন কম-বেশি হতে পারে।'
এখন বনমুরগি ও মোরগ বিক্রি করে ভালো আয় করছেন এই দম্পতি। খামারে থাকা ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৫টি মোরগ-মুরগির খাবারের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৬ কেজির মতো ধানের প্রয়োজন হয় তাদের।
এই বনমোরগকে মারমা ভাষায় বলে 'তহ্ক্রাক'। আর ঘরে পোষা মোরগকে বলা হয় 'তোয়াইং গ্যাং' বা তইক ক্যাং।
পোষমানা মোরগ আর বনমোরগের গঠন, আকার-আকৃতি, ডাক সবই প্রায় একরকম। তাই বিশেষ করে পাহাড়ি বনমোরগকে ফাঁদে ফেলে জীবন্ত শিকারের জন্য তোয়াইং গ্যাং বা তইক ক্যাংকেই ব্যবহার করা হয়।
শোয়ে অং মারমা জানান, যেহেতু পাহাড়ে বনমোরগ কমে গেছে, আবার এগুলোর চাহিদাও বেশি। তাই খামার বানিয়ে দেশি মুরগির মতো এই বনমোরগের বাণিজ্যিক চাষ করা তাদের স্বপ্ন।
'অভূতপূর্ব ঘটনা'
সংগৃহীত ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বনমোরগের খামারে রূপ দেওয়ার এই ঘটনাটিকে 'অভূতপূর্ব' বলে অভিহিত করেছেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যদি কোনো বন্য প্রাণীকে সরাসরি বন থেকে এনে গৃহে প্রতিপালন করা হয় তাহলে বন্যপ্রাণী আইনে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এমন অপরাধের জন্য জেল-জরিমানার বিধান আছে।
'তবে শোয়ে অং মারমা যেভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বনমোরগের বংশবিস্তার করেছেন, খামার গড়ে তুলেছেন তা অভূতপূর্ব একটা ঘটনা। কারণ, এগুলো আদতে গৃহেই উৎপাদন ও প্রতিপালিত হচ্ছে। তাই এটি অপরাধের আওতায় পড়বে না।'
এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. পলাশ কান্তি চাকমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সাধারণত মুক্ত, অর্ধমুক্ত ও বন্দি অবস্থায় মুরগি পালন করি। দেশি মুরগির মতো বনমোরগের রোগবালাই কম, তবে রাণীক্ষেত, কলেরা, পক্স এই রোগগুলো হয়ে থাকে। যদিও ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে এই রোগ থেকেও প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।'
খামারি যদি প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে এসে যোগাযোগ করেন তাহলে চিকিৎসা ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।
Comments