লজ্জাবতী বানর সংরক্ষণে পরানো হচ্ছে রেডিও কলার
বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় খাবারের সন্ধানে বনের পাশে গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করায় গ্রামবাসীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে লাউয়াছড়ার লজ্জাবতী বানর। এসব আহত বানরদের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধারকেন্দ্রে এনে সেবা দিচ্ছে 'প্লামপ্লোরিস ইভি' নামের একটি সংগঠন।
পাশাপাশি লজ্জাবতী বানরের আচরণ, চলাফেরা এবং জীবনধারা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য কয়েকটি বানরের গলায় রেডিও কলার লাগানো হয়েছে।
অনেক সময় এই নিরীহ প্রাণীগুলো বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এসেও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। উদ্ধার হওয়া এসব বানরের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং যত্ন প্রদানের জন্য কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'প্লামপ্লোরিস ইভি'। তারা বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা এবং প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সঙ্গে সহযোগিতায় কাজ করে।
গত এক বছরে উদ্ধার হওয়া ২৩টি লজ্জাবতী বানরের মধ্যে ১৫টি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী গবেষক, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং প্লামপ্লোরিস ইভি সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লজ্জাবতী বানর ধরা পড়ছে। এরা নিশাচর প্রাণী। রাতের বেলা হাঁটার সময় খোলা বৈদ্যুতিক তারে ছোঁয়ায় প্রায়ই আঘাত লাগে। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, প্রাণীপ্রেমী ও পরিবেশকর্মীরা আহত প্রাণীদের উদ্ধার করছে।
২০২২ সাল থেকে, জার্মানভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্লামপ্লোরিস ইভি লজ্জাবতী বানরকে বাঁচাতে কাজ করছে। এরপর থেকে ২৩টি লজ্জাবতী বানরকে বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করে জানকিছড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসব প্রাণীর পরিচর্যা, চিকিৎসা ও খাওয়ানোর বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছেন। এই ২৩টি লজ্জাবতী বানরের মধ্যে ১৫টি ইতোমধ্যে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা এবং প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহযোগিতায় গত বছরের ১০ মার্চ প্লামপ্লোরিস ইভি প্রথম বানরটি অবমুক্ত করে। সবশেষ ১৭ জুন আরেকটি অবমুক্ত হয়েছে।
লজ্জাবতী বানরের আচরণ, চলাফেরা এবং জীবনধারা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ১৫টি লজ্জাবতী বানরের মধ্যে ৪টিতে রেডিও কলার লাগানো হয়েছিল। গত বছরের ২০ অক্টোবর প্রথম রেডিও-কলার লাগানো লজ্জাবতী বানর অবমুক্ত করা হয়। কলার পরানো শেষ বানরটি অবমুক্ত করা হয় গত ১৭ জুন। ২৩টি বানরের মধ্যে দুটি মারা গেছে। এ ছাড়া জনকিছড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্রে রয়েছে ৬টি।
ওই ৬টি বানরের মধ্যে লুলা নামে একটিকে গত বছরের ১৮ জুলাই শ্রীমঙ্গলের জেরিন চা বাগান থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। লুলার পা ভেঙে গিয়েছিল, তবে এখন সুস্থ। অন্য ৫টি বানরের মধ্যে শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়া চা বাগান থেকে দুটি, হবিগঞ্জের একটি ও শ্রীমঙ্গল থেকে দুটি উদ্ধার করা হয়েছে।
এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে সেগুলো উদ্ধার করা হয়। গত এক সপ্তাহ আগে শ্রীমঙ্গল থেকে একটি বানর উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ফুলছড়া থেকে একটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে উদ্ধার করা হয়। এখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। এর এক্স-রে রিপোর্টও ভালো এসেছে।
প্লামপ্লোরিস ইভির ডেপুটি ম্যানেজার আজিজুল হাকিম আবির এই প্রতিবেদককে বলেন, 'এখন অনেক লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করা হয়। আগে আহতরা মারা যেত। মানুষ মেরে ফেলতো। এখন ধরা পড়লে মানুষ আমাদের জানায়। উদ্ধারের পর উদ্ধারকেন্দ্রে রেখে তাদের চিকিৎসা করানো এবং নার্সিং সার্ভিসসহ ভালো খাবার দিয়ে তারপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কর্মসূচিতে বিপন্ন লজ্জাবতী বানরকে বাঁচানো হচ্ছে।'
হাকিম আবির জানান, লাউয়াছড়ায় রেডিও কলার পরা ৪ লজ্জাবতী বানরের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বছর দুয়েক পর তাদের আচরণ, চলাফেরার ধরন বোঝা যাবে। এ কাজে সহযোগিতা করছে বন বিভাগ।
প্লামপ্লোরিস ইভির মতে, স্লো লরিসকে জার্মানি থেকে আমদানি করা আঠা, ফড়িং, চাষ করা পোকামাকড়, গাজর এবং শসা খাওয়ানো হয়। নারী লজ্জাবতী বানরের ওজন সর্বনিম্ন ৮০০ গ্রাম এবং পুরুষের ওজন ৯০০ গ্রাম।
এ ছাড়া দুটি লজ্জাবতী বানর মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের একটির ওজন ১ হাজার ১৫৫ গ্রাম এবং অন্যটির ওজন ৮৫০ গ্রাম। একটু বেশি ওজন বাড়ানোর পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
একটি নতুন, অপরিচিত জায়গায় লজ্জাবতী বানর ছেড়ে দিলে পুরোনোদের সঙ্গে মারামারি হয়। এ জন্য যে এলাকা থেকে উদ্ধার করা হবে, সেই এলাকার কাছাকাছি জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) লজ্জাবতী বানরকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। বৈজ্ঞানিক নাম Nycticebus bengalensis. এই নিশাচর প্রাণীটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনাঞ্চলে বাস করে।
লজ্জাবতী বানর বনের গভীরে উঁচু গাছে থাকতে পছন্দ করে। দিনের বেলায় গাছের গুঁড়িতে বা ঘন পাতার নিচে ঘুমায়।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, 'লজ্জাবতী বানর বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়েছে। প্লামপ্লোরিস ইভি লজ্জাবতী বানর নিয়ে গবেষণা করছে এবং প্রাণীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা ভালো একটা ধারণা নিতে পারবো।'
Comments