‘ভূতের গল্লির’ চানমিঞা কি সত্যিই ‘বান্দরের’ দুধ খেয়েছিল?

‘মুখের দিকে দেখি’ উপন্যাসের শুরুটা চানমিঞার বান্দরের দুধ খাওয়ার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়। তবে সত্যিকার অর্থেই চানমিঞা ‘মানবসদৃশ’ এই প্রাণীটির দুধ খেয়েছিল কি না, তা উপন্যাসের শেষ অবধি বোঝার উপায় থাকে না।
পুরান ঢাকার ভূতের গল্লির চানমিঞা যে বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা ছিল, সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন প্রতিবেশী মিসেস জোবেদা রহমান। তাই কোনো কারণে চানমিঞার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি এই ব্যতিক্রমী ঘটনাটি তার কাছেপিঠে আসা কাউকে জানাতে ভুলতেন না।
এই বানর পরিবারটি ভূতের গলির নয়। গুলশানের। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

পুরান ঢাকার ভূতের গল্লির চানমিঞা যে বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা ছিল, সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন প্রতিবেশী মিসেস জোবেদা রহমান। তাই কোনো কারণে চানমিঞার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি এই ব্যতিক্রমী ঘটনাটি তার কাছেপিঠে আসা কাউকে জানাতে ভুলতেন না। মহল্লার অন্য কেউ ব্যাপারটি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলে তিনি তা নিয়ে তর্ক করতেন, প্রয়োজনে ঝগড়াও।

ভূতের গলির এই বানর, চানমিঞা ও জোবেদা রহমান জাদুকর লেখক শহীদুল জহিরের উপন্যাস 'মুখের দিকে দেখি'র তিন চরিত্র। শক্তিমান এ ঔপন্যাসিক তার রচনায় জাদুবাস্তবতার যে মায়াজাল বিছিয়ে রাখেন, সেখানে খুবই বাস্তববাদী বর্ণনার ভেতর হঠাৎ এমন এমন প্রসঙ্গ এসে পড়ে যা ঠিক যুক্তির বিচারে টেকে না। কিন্তু যুক্তিনির্ভর আর যুক্তিহীন ব্যাপারগুলো অবলীলায় পাশাপাশি ঘটতে থাকে।

সেভাবেই 'মুখের দিকে দেখি' উপন্যাসের শুরুটা চানমিঞার বান্দরের দুধ খাওয়ার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়। তবে সত্যিকার অর্থেই চানমিঞা 'মানবসদৃশ' এই প্রাণীটির দুধ খেয়েছিল কি না, তা উপন্যাসের শেষ অবধি বোঝার উপায় থাকে না। সংশয়টুকু থেকেই যায়।

শহীদুল জহির লেখেন, '…মহল্লার বাড়িঘরের ছাদ এবং দেওয়ালের উপর দেখা যেত এই বান্দরদের, তাদের খয়েরি রঙের পিঠ, সাদাটে পেট এবং লাল পশ্চাদ্দেশ; তারা দেওয়ালের উপর দিয়া হেঁটে যেত অথবা কোনো বাড়ির কার্নিশে লেঙ্গুর ঝুলায়া শুয়ে থাকতো। তখন হয়তো বান্দরদের এই দলে একটা/দুইটা বা অনেকগুলা মাদি বান্দর ছিল, বাচ্চাঅলা বান্দরনিদের পায়ের ফাঁকে বুকের সঙ্গে বাচ্চা ঝুলে থাকতো। হয়তো এইরকম কোন একটা বান্দরনির দুধ চানমিঞা খেয়েছিল,…।'

পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা। ছবি: সোহাগ মহাজন

শহীদুল জহিরের সর্বশেষ এই উপন্যাসে কোনো সময়কাল উল্লেখ নেই। তবে এখনো সংখ্যায় অল্প হলেও পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া, মিলব্যারাক, বনগ্রাম, মৈশুণ্ডি, জনসন রোড, রথখোলা ও টিপু সুলতান রোডের মতো এলাকাগুলোয় ঢাকাবাসীর অপ্রিয় ও অনাদরের এই সঙ্গীদের দেখা মিলবে উপরের বর্ণনার মতো করেই। পাশাপাশি এদের পাওয়া যাবে উত্তর ঢাকার মিরপুর ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, ওল্ড ডিওএইচএস, বারিধারা ও গুলশানের একাংশে।

'বুদ্ধিমান' বানরের সঙ্গে মানুষের সংযোগটা বড় অদ্ভুত। শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিয়েছেন আর বানরের নাম মুখে আনেননি, এমন শিক্ষক খুঁজে পাওয়া বিরল। আবার এমন কোনো বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া যাবে না, যারা বানরকে অনুষঙ্গ করে তাদের সন্তানকে ডাকেননি। এছাড়া বন-জঙ্গলের পরিসরের বাইরে গণিত শিক্ষায় পিচ্ছিল বাঁশের গা বেয়ে ওঠা-নামা করার সূত্রে কিংবা চিড়িয়াখানার বদ্ধ খাঁচায় আটকা বানরের 'বাঁদরামি' কিংবা বানরখেলার সূত্রেও এই প্রাণীটি সবার পরিচিত।

প্রায় দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরেও সবচেয়ে পরিচিত বন্যপ্রাণী হিসেবে পরিচিতি আছে বানরের। কিন্তু হনুমানের মতো এরা কোনোভাবেই পূজিত নয়; বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিগৃহীত। এ কারণেই কি না অনেকে এদের দেখলেই জান্তব আগ্রহে ঢিল ছুড়তে শুরু করে। এমনকি খাবারের খোঁজে থাকা এই ছোট্ট প্রাণের দেহ গরম পানিতে ঝলসে দেওয়ার খবরও পাওয়া যায়। আর আহত শরীর লুকানোর চেষ্টায় বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মারাও পড়ে এদের কেউ কেউ।

কংক্রিটের জঙ্গলে বানর কীভাবে এলো?

সতেরো শতকের শুরুতেও আদি ঢাকার উত্তরে মিরপুর, কুর্মিটোলা, পল্টন এবং তেজগাঁও এলাকায় ছিল চারটি দুর্ভেদ্য জঙ্গল। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে কামরাঙ্গীরচর ছিল এক বিস্তৃত জলাবন। এসব বনে বিচরণ ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ, শুয়োর, কুমির, ঘড়িয়াল, অজগর, বানরসহ বিচিত্র সব প্রাণীর।

একবিংশ শতাব্দীর প্রায় সিকিভাগ পেরিয়ে এখন কংক্রিটের অট্টালিকা এসব জায়গায়। পশুপাখিরা বিদায় নিয়েছে। তবে সবাই নয়, বানরের মতো অনেক প্রাণী টিকে আছে।

প্রাচীন বিশ্বের বানর প্রজাতিগুলোর মধ্যে সবেচেয় পরিচিত প্রজাতি এটি। খাবার যতটা খায়, নষ্ট করে তার চেয়ে বেশি। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত 'এনভায়রনমেন্ট অব ক্যাপিটাল ঢাকা' গ্রন্থে রাজধানীর গাছপালা, বন্যপ্রাণী, বাগান, পার্ক, উন্মুক্ত জায়গা ও জলাশয়সহ সার্বিক প্রাকৃতিক প্রতিবেশ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। এর 'ওয়াইল্ড লাইফ অব ঢাকা' শীর্ষক প্রবন্ধে লেখকেরা সরকারি নথির বরাত দিয়ে বলছেন, ১৮০৪ সালেও ঢাকায় শিকারিরা ২৭০টি বাঘের চামড়া জমা দিয়েছিলেন পুরস্কার ও স্বীকৃতির আশায়।

এই অঞ্চলে জনবসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের পরিসর আশঙ্কাজনক হারে কমে আসা এবং তার পরিণতিতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সংঘাতও ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।

পুলিশের ১৮৩৭ সালের হিসাব অনুসারে, ওই সময় ঢাকায় বছরে অন্তত এক জন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা পড়ত।

এমনকি গত শতকের শুরুর দিকের সরকারি হিসাব বলছে, ১৯০৭ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে ঢাকায় ১৩টি বাঘ মারা পড়েছিল শিকারিদের হাতে।

এরপর পেরিয়ে গেছে আরও ১০০ বছর। ঢাকা পরিণত হয়েছে প্রায় দুই কোটি মানুষের নগরে। সুউচ্চ ভবনসহ নানাবিধ স্থাপনা, কল-কারখানা আর সারি সারি গাড়ির যান্ত্রিক চিৎকার এই শহরকে পরিণত করেছে কংক্রিটের জঙ্গলে। তবু মাঠ-প্রান্তর-সবুজহীন এই রুক্ষ নগরে এখনো টিকে আছে অনেক বন্য প্রাণ। কোনোটি স্বল্প পরিসরে। আবার অবিশ্বাস্য হলেও কোনো কোনো প্রজাতি আছে লক্ষ-কোটিতে।

প্রায় ৪৫ পৃষ্ঠার 'ওয়াইল্ড লাইফ অব ঢাকা' প্রবন্ধের শেষাংশে তিন লেখক সৈয়দ মো. হুমায়ুন কবির, ইনাম আল হক ও মো. আনোয়ারুল ইসলাম ঢাকায় এখন পর্যন্ত টিকে থাকা প্রাণীদের তালিকা সংযুক্ত করেছেন। সেখানে বানরের নামও আছে।

দখল। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

'কিংবদন্তীর ঢাকা'র বানর কোন প্রজাতির

ঢাকায় টিকে থাকা এই বানরগুলো রেসাস প্রজাতির (macaca mulatta)। এটি স্থানীয়ভাবে 'লাল বান্দর' নামেও পরিচিত। দলবেঁধে থাকতে পছন্দ করে ও কলহপ্রিয়।

বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন বিশ্বের বানর প্রজাতিগুলোর মধ্যে সবেচেয় পরিচিত প্রজাতি এটি। খাবার যতটা খায়, নষ্ট করে তার চেয়ে বেশি। এখনো পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয়ে এদের নিরাপদ রাত্রিবাসের নিশ্চয়তা আছে।

চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় তার স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ 'সত্যজিৎ স্মৃতি'তে লিখেছেন, 'আমার মামার বাড়ি ওয়ারীতে, র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। সে বাড়ি এখন আছে কি না জানি না। সে রাস্তা এখন আছে কি না জানিনা। বাড়ির কথা কিছু মনে নেই। মনে আছে শুধু যে প্রচণ্ড বাঁদরের উপদ্রব।'

অনাদরের অপর পিঠে আদরও আছে, আছে মমতা

ঢাকার বানরদের ঢিল ছোড়ার মানুষের অভাব যেমন হয় না, তেমনি এদের প্রতি মায়া দেখানো মানুষের সংখ্যাও কম নয়।

সম্প্রতি গুলশান এলাকায় দেখা গেল কিছু মানুষ বানরের দলকে রুটি-কলা খাওয়াচ্ছেন। জাহাঙ্গীর গেট এলাকায় বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থীদের অনেকে নিয়মিত বানরদের বাদাম-বিস্কুট খাওয়ান। কিছুদিন আগেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকার তিনটি এলাকায় বানরদের জন্য গাজর, কলা, শসা, টমেটো কিংবা বাদাম দেওয়া হতো। এখনো গেন্ডারিয়ায় সাধনা ঔষধালয় প্রাঙ্গণে বন বিভাগের পক্ষ থেকে বানরদের জন্য খাবার ছড়িয়ে রাখা হয়।

ঢাকার বানরদের ঢিল ছোড়ার মানুষের অভাব যেমন হয় না, তেমনি এদের প্রতি মায়া দেখানো মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ছবি: সোহাগ মহাজন

আদর-ভালোবাসার স্পর্শ পেলে বানরের মতো এমন অবাধ্য ও চঞ্চল প্রাণীও যে বশীভূত হয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় নাজির হোসেনের লেখায়। তার বিখ্যাত 'কিংবদন্তীর ঢাকা' গ্রন্থে তিনি বলছেন, 'বানররা স্বভাবতই উচ্ছৃংখল প্রাণী। কিন্তু তাদের যেমন ছিল বুদ্ধি, তেমনি ছিল সাহস। তারা সুযোগ বুঝে মানুষের মতো ঘরের শিকল খুলে ঘরে ঢুকে খাবার-দাবাড়গুলো সাবাড় করে দিতো। রান্না করা ভাতের হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে গিয়ে উঠতো ঘরের ছাদে, গাছের ডালে। খাবার না পেলে অনেক সময় কাপড়চোপড় নিয়ে গাছে বা ছাদে উঠতো। গৃহিণীরা আদর করে খাবার–দাবার দিলেই, তবেই তারা সেগুলো ফেরত দিতো।'

এখনো পুরান ঢাকার বানরগুলো খিদে পেলে মাঝেমধ্যে মানুষের হাত থেকে খাবার ছিনিয়ে নেয়, ঘর-বারান্দা কিংবা ছাদ থেকে জামাকাপড় অথবা ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে যায়। আবার একটু আধটু খাবার ওদের দিকে ছুড়ে দিলে তা ফেরতও দেয়।

এমন পরিস্থিতিতে মানুষের সঙ্গে 'বানরসমাজের' যে সম্পর্ক আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে, তাতে ভূতের গলির চানমিঞা যে কোনো একটা ঘটনাক্রমে বানরের দুধ খায়নি—তা-ও বা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?

Comments

The Daily Star  | English

Political parties want road map to polls

Leaders of major political parties yesterday asked Chief Adviser Prof Muhammad Yunus for a road map to reforms and the next general election.

4h ago