‘গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়বে না, এ কথা সরাসরি প্রতারণা’

বিদ্যুতের দামবৃদ্ধিকে 'দুরভিসন্ধিমূলক' বলে অভিহিত করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

আজ সোমবার বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাইকারি পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম হবে ৬ টাকা ২০ পয়সা, যা আগে ছিল ৫ টাকা ১৭ পয়সা।

এর প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক এম শামসুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার অযৌক্তিক ব্যয় না কমিয়ে এভাবে দাম বাড়াচ্ছে।'

গত ১৮ মে অনুষ্ঠিত বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি সম্পর্কিত গণশুনানির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, 'বিদ্যুতের যে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেখানে ৭ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি করে দাম বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। ফার্নেস অয়েল ও এলএনজির মাধ্যমে এই ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরবরাহ করা হবে, এমন প্রস্তাব ছিল। পরবর্তীতে দেখা গেল, সেই অজুহাতে এলএনজির দাম বাড়লো, কিন্তু এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে আনা হলো না। ফার্নেস অয়েলও না এনে লোডশেডিংয়ে চলে যাওয়া হলো। তার মানে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির যে কথা বলা হলো, সেটা একটি প্রতারণা বা প্রহসনে পরিণত হলো।'

তিনি আরও বলেন, 'গ্যাসের দামবৃদ্ধি করা হলো প্রায় ২৩ শতাংশ। এরপর স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না এনে এলএনজিতে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার যে ঘাটতি ছিল, সেটা সমন্বয় করা হলো। সেই ঘাটতির মধ্যে সরকারের মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা ছিল। বাকি পুরোটা ভোক্তাদের পয়সা। জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে নেওয়া হলো ৬ হাজার কোটি টাকা, কোম্পানিগুলোর বাড়তি সঞ্চিত মুনাফা থেকে নেওয়া হলো আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই টাকায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হলো না, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিভিত্তিক এলএনজি আনার পরিমাণও কমিয়ে দিলো। যেখানে ৭০০ বা সাড়ে ৭০০ এর উপরে আনার কথা, সেখানে ৩৫০ থেকে ৩৬০ এমএমসি গ্যাসও আনা হয়েছে। এভাবে এলএনজির আমদানি কমিয়ে গ্যাসের ভর্তুকি কমানো হয়েছে বা সমন্বয় করা হয়েছে।'

'আমরা ধারণা করছি, যে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে, তাতে রাজস্ব আয় উদ্বৃত্ত থাকবে। ২০২০-২১ সালে এলএনজি আমদানি কমানোর কারণে সাশ্রয় হয়েছিল', যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আবেদনের ভিত্তিতে গত ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির জন্য গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে তারা। এ বিষয়ে গণশুনানি শেষে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ঘোষণা দেয়, বিদ্যুতের দাম আপাতত বাড়ছে না।

সেই শুনানির বিষয়ে শামসুল আলম বলেন, 'শুনানি সম্পন্ন হলো, ২৪ বা ২৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি সমন্বয়ের কথা এলো। সেখানে আমরা দেখিয়েছি, কস্ট রেশনালাইজ করা হলে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো যায়। এই অর্থ আসলে লুণ্ঠনমূলক, যা সমন্বয় হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে। ব্যয় সমন্বয় হয়েছে, মুনাফা সমন্বয় হয়েছে। যেমন: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে সার্বিকভাবে মুনাফা দেওয়া হয়েছে ১৮ শতাংশ, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে মুনাফা হয়েছে ১৬ শতাংশ। যেখানে বিইআরসি নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড মুনাফা ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।'

দেশের বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'শুধু যে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, এলএনজি, ফার্নেস ওয়েল, কয়লার দাম বেড়েছে বলেই বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি, তা সঠিক কথা নয়। পাওয়ার প্ল্যান্ট, ট্রান্সমিশন লাইন, ডিস্ট্রিবিউশন লাইনসহ সবক্ষেত্রে যৌক্তিক ব্যয়ের চেয়ে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি ব্যয় করা হয়েছে। যেখানে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা লাগে, সেখানে ২৫০ কোটি টাকা খরচ করে গ্যাসকূপ খনন করা হয়েছে। যেখানে ট্রান্সমিশন লাইন তৈরি করতে ১০০ কোটি টাকা লাগে, সেখানে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।'

'তারপরও লোডশেডিং দেওয়া হয়েছে। লোডশেডিং দিয়ে সরবরাহ কমানো হয়েছে, বিদ্যুতের সরবরাহ অনেক কমে গেছে, চাহিদা কমানো হয়েছে। এখন লোডশেডিং নেই। লোডশেডিং না থাকলে কী পরিমাণ চাহিদা দিয়ে সেই ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি ধরেই দাম বৃদ্ধি করা হলো? এটা তো ন্যায্য যুক্তি হতে পারে না।'

১৮ মে অনুষ্ঠিত গণশুনানির ভিত্তিতে বিইআরসি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তার ওপর রিভিউ আবেদন করে পিডিবি। সেই রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই আজ বিদ্যুতের দাম প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা এলো।

এ বিষয়ে শামসুল আলম বলেন, 'মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে না বলে একবার তো আদেশ হয়ে গেছে। সেখানে রিভিউ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই রিভিউ আবেদনের ওপর আবার গণশুনানি হতে হবে। আদালতও তো রিভিউ করে। সেখানেও তো ২ পক্ষের শুনানি হয়, তারপর সিদ্ধান্ত আসে। এই রিভিউ প্রস্তাবেও আবার গণশুনানি হতে হবে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তাদের আবেদন ন্যায্য কি না। অথচ, দুরভিসন্ধিমূলকভাবে এই শুনানি এড়িয়ে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই যে প্রায় ২০ শতাংশ দাম বাড়ানো হলো, এটা কোনোভাবেই ন্যায্য হয়নি, যৌক্তিক হয়নি, আইনসম্মত হয়নি। বিচারিক যে নর্ম, সেই নর্মকে তছনছ করা হয়েছে, আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। আইন লঙ্ঘন এখন একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে।'

নতুন দাম ঘোষণার পর আজ সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, 'গ্রাহক পর্যায়ে এখনই দাম বাড়ছে না। জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।'

এ বিষয়ে শামসুল আলম বলেন, 'পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লে তা গ্রাহক পর্যায়ে বাড়বে না, এটা কোনো দূরদর্শী বা যৌক্তিক কথা না। এটা কথার কথা। এই কথার কোনো ভিত্তি নেই। এই পয়সা যেভাবেই হোক, কোনো না কোনোভাবে ভোক্তার পকেট থেকেই নেওয়া হবে।'

'এখনই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়বে না— এই কথাকে গ্রামের ভাষায় বলা যায়, ঢপ মারা। এটা সরাসরি প্রতারণা', যোগ করেন তিনি।

সরকার অযৌক্তিক ব্যয় না কমিয়ে এভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর বিষয়টি তারা এড়িয়ে গেল। দুর্নীতির দায়, অদক্ষতার দায়সহ সবই আমরা দেখিয়ে দিলাম। অথচ সেটা না কমিয়ে সেখানে থেকে যে ঘাটতি হলো, সেটার হিসাব করে মূল্যবৃদ্ধি করা হলো।'

'প্রতারণামূলক, দুর্নীতিমূলক, লুণ্ঠনমূলক ঘাটতি দেখানো হচ্ছে। প্রতারণা, দুর্নীতি, লুণ্ঠন না এড়িয়ে জনগণকে দেখানো হচ্ছে বিদ্যুতের জন্য খরচ কত। সেই খরচ জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে। অথচ সরকারের দায়িত্ব ছিল মূল্য যৌক্তিক করা। সেখানে উল্টো বলা হচ্ছে যে এটা জনগণের ওপরে বাস্তবায়ন করা হবে। তার মানে জনগণের আপত্তি প্রশমন করা হচ্ছে না। এটা তো দুরভিসন্ধিমূলক', যোগ করেন অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

Comments

The Daily Star  | English
Reforms vs election

Reforms vs election: A distracting debate

Those who place the election above reforms undervalue the vital need for the latter.

3h ago